খান চমন-ই-এলাহি
বাঙালি ও বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ১৫ আগস্ট শোক ও শক্তির উৎস। নির্মম নিষ্ঠুর হৃদয় বিদারক এক দৃশ্যের জন্ম হয় মুক্তির সূর্য উদিত হতে না হতেই। চেতনাকে বিনষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লাগা দেশবিরোধী কতিপয় ক্ষমতা লোভীদের হাতে সমগ্র মানুষের স্বপ্ন-সাধ-আকাঙ্ক্ষা জিম্মি হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অবিনশ্বর চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী চক্র। যা হৃদয়ে আজো স্মরণের হেতু হয়ে আছে। এমনকি যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে হাজার বছরের চেতনাকে সর্বাগ্রে নিয়ে এসেছে। নতুন এক লাল সবুজের পতাকা খচিত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে বিশ্ব জয়ের ব্যবস্থা করেছে তকে চিহ্নহীন করার অপতৎপরতা প্রদর্শন করে। ফলে যে হঠকারী রাজনীতির জন্ম হয় তার থেকে বেরিয়ে আসার কোন সুপথ খুঁজে পায়নি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-শৈলদা-ঘাঘর-মধুমতি-কর্ণফুলী-পিয়াইন আর হরিণঘাটার মানুষ। অথচ তিনি কোন সাধারণ মানুষ নন, তিনি সাধারণের মধ্যে হয়ে ওঠা অসাধারণ মানুষ। তিনি আমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠজন। তিনি সকল পথ-মত ও আদর্শের মানুষের চির আপনজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিবুর আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার কর্ম আছে সর্বত্র। এই দেশ, এই শ্যামলিমা, এই তৃণাচ্ছাদিত পললভূমির প্রতি ইঞ্চি জমিনে। তিনি জীবন্ত হয়ে আছেন মাঝির ভাটিয়ালি গানে, রাখালের বাঁশিতে, গারোদের স্বাধীন নৃত্যে নৃত্যে। তিনি এমন এক জাতির মানসপটে জায়গা করে নিয়েছেন যে জাতি সাহসে-সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে কাল থেকে কালান্তরে চেতনার দীপ শিখা জ্বেলে রক্তগঙ্গা পেরিয়ে স্বাধীন-স্বদেশের মানচিত্র জন্ম দিয়েছেন।
অবিভক্ত বৃটিশ-ভারতের ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা শিরোনামে নিয়ে আসা একটি কালজয়ী শ্রেষ্ঠ কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। জীবন সংগ্রামে, জাতীয় সংগ্রামে মাটি ও মানুষের সাথে নিবিড় বন্ধনের বান্ধব নেতা শেখ মুজিব ভারত পাকিস্তান সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন কোটি কোটি মানুষের অন্তরে। পরবর্তীকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' গীতি কবিতা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে বাঙালির প্রেমের যে নজীর সৃষ্টি করেছেন তা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, উভয় বাংলায়, এমনকি তামাম দুনিয়ার তাবৎ বাঙালি আজ বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা এবং স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রশংসায় সতত ব্যস্ত। ভ্রান্তি-বিভেদের জাল ছিন্ন করে সাহসী দৃপ্ত কণ্ঠে বজ্রের শব্দের ন্যায় দরাজ কণ্ঠে শেখ মুজিব যখন ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' শ্রোতা-দর্শক ও পাঠক হৃদয়ে এ দৃপ্ত ঘোষণা মুক্তির কবিতা পবিত্র বাণীবন্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ফরাসী বিপ্লব, ম্যাগনা কার্টা কিংবা গ্যাটিসবার্গ এ্যাড্রেস'র ন্যায়। কবি, জাতির জনক মৌনতার মানুষ ছিলেন না বলেই বারবার জেলের ভেতর থেকেও সগৌরবে শেকড় সন্ধানী মানুষের মতো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিংহের ন্যায় পাঞ্জাবি খান সেনাদের বিরুদ্ধে হুংকার ছেড়েছেন গর্জে উঠেছেন বাঘের ন্যায়। বাঙালিত্ব অনুসন্ধান করে উর্ধ্বাকাশে, বিশ্বের দেশে-দেশে মানবিকবোধে উজ্জীবিত মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন নতুন এক বার্তা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ফলে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, রক্ত আর অশ্রুপাতে স্বদেশের প্রতি ইঞ্চি জমিনে নতুন সূর্যোদয় ঘটে। আলোকের বন্যায় ভেসে যায় তাবৎ অন্ধকার। নিরূপম সি্নগ্ধতা পায় রাতের আকাশ। জোছনার শামিয়ানায় ঢাকা পড়ে তৃণাচ্ছাদিত প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গড়ে ওঠা ভূমি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয় ঠিকই কিন্তু স্বাধীনতার কিছু কাল পরেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে রক্তের ধারা বয়। ক্ষত চিহ্ন অঙ্কিত হয় লাল সবুজে উড্ডীন পতাকার নবীন ভোরে। সূর্যালোকিত শিশির সিক্ত সকালে। বঙ্গবন্ধুকে ১৫ আগস্ট হত্যার মধ্য দিয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠে। অমাবস্যার যে দীর্ঘ কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয় তা অব্যাহত থাকে। গণতন্ত্র নির্বাসনে যায়। ছাউনি থেকে আসা ইউনিফর্ম পরিহিত সশস্ত্র মানুষের হাতে ক্ষমতা মুষ্টিবদ্ধ হয়। আইনের শাসন তিরোহিত হয়। সন্ন্যাস যুগের সৃষ্টি হয়।
অবিশ্যি তাই বলে বাঙালি দমে যায়নি। মুখ ফিরিয়ে নেয়নি সজীব প্রাণের বাঙালি। তারা গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখে তাঁর তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। দেশে এখন গণতান্তিক পদ্ধতি চালু। এটি মূলত বাঙালির অর্জন। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার প্রয়াস। আজ বঙ্গবন্ধু নেই। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শূন্য। সেই ১৯৭৫'র ১৫ আগস্ট আমরা 'রাহবার' বা 'পথ প্রদর্শক' হীন হয়ে পড়ি। কিন্তু ক্যানো? নির্মম-নিষ্ঠুর হননে আমরা যে বঙ্গবন্ধুকে হারাই। হারাই বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানকেও যিনি জাতির মুক্তিদাতা, ত্রাণকর্তা। যিনি ভারতের মহাত্মা গান্ধী, পাকিস্তানের জিন্নাহ, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন'র মতো বাঙালি জাতির পিতা।
কোনো মৃত্যু কারো কাম্য নয়। আর সে মৃত্যু যদি হয় মানুষের হাতে তাহলে তার থেকে দুঃখজনক আর কিছুই থাকতে পারে না। কারণ পবিত্র কোরানে হত্যা না করার জন্য নির্দেশ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে এবং শিশু-নারীকে হত্যা করে খুনীরা নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেছে। সে নিষেধাঞ্জা পবিত্র ধর্মের, সে নিষেধাজ্ঞা পবিত্র সংবিধানের। তারপরও বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা নিয়ে বাঙালির কোনভাবে বেঁচে থাকা। তাদের প্রত্যাশা একদিন বঙ্গবন্ধুর সকল খুনির বিচার হবেই। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণতান্ত্রিক বোধে উজ্জীবিত সরকার সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন, নিশ্চয়ই। যুগপৎ গণতন্ত্রের মানসকন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক খান আজিজুল হকের মতো জানা-অজানা কবিদের বিশ্বাসে উঠে আসা জনপ্রত্যাশা 'মুজিববাদ' কবিতার সার্থক প্রয়োগ হবে এবং উচ্চারিত হবে-'নর-ললনা সকল বিভেদ ঘুচাতে আজ/বরণ করি একটি কথায় মুজিববাদ।'
খান চমন-ই-এলাহি : কলামিস্ট