শাহমুব জুয়েল
সত্যিই কত মমতা পুষলে জীবনের চেয়ে বেশি ভাবা যায়। যার মধ্যে হিম্মত থাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি থাকে, সব বিন্ধ্যাচলকে উপড়ে তিনিই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ তার মধ্যে কবিত্বশক্তি ছিল, তাই তিনি কবিতার মতো বাংলাদেশ আনয়ন করলেন কিন্তু দুর্ভাবনার দুঃস্বপ্নের বিষয় সে কবিকে তারা নিঃশ্বেস করে দিল লজ্জা! লজ্জা! ঢেকে রাখার মতো কী। সময়ের পর সময় এলো বিচার হলো হন্তারকদের কিন্তু কবির জন্য কবিদের যে কবিতা তা চেতনাময় হলো দেখে যেতে পারলেন না সে কবিরা। কখনো নীরব কখনো সরব ভাষায়- দেশের দৌপায়ায়, গ্রাম বাংলার দো-ছিপায়, মঞ্চে চায়ের কাপে, সমুদ্রজয়ে, নদীর পারাপারে, মাঝিমালস্না, কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক, উঠতি ও সময়ের স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশ নামক কবিতার ছন্দগাথা রাজনীতির কবির নাম, যশ ও খ্যাতি। আশাবাদ এবং বিশ্বাস বিশ্বময় কবির নাম ছেয়ে গেছে তা চিরকালীন স্ন্যাপ, উপড়ানোর চেষ্টা বৃথা ও দুঃসাধ্য।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (জন্ম : ১৭ মার্চ ১৯২০ টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, হত্যাকান্ড : ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ধানমন্ডি-৩২, ঢাকা।) জন্ম থেকেই যাঁর চোখেমুখে অধিকারের সচেতনতা। আত্মবিসর্জনের মহিমায় ঔদার্য পুরুষ তিনি। কী যাদু ছিল তার কণ্ঠে, কী বোধ ছিল তার তর্জনী সংকেতে গোটা বাঙালি সেদিন অনুগতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শহর নগরের অলিগলি থেকে ঝেঁপাঝাড়ের দো-ছিপা পর্যন্ত। তার নেতৃত্বগুণে ঐক্যবদ্ধ অধিকার সচেতন বাঙালি। তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল অধিকার রক্ষা করা তা করতে প্রয়োজনে শত্রম্নবধ করতেও দ্বিধা নেই, সেই ঐতিহাসিক মহাপুরুষ তিনি। তাকে নিয়ে কথা বিশ্বভূগোলে; কথা হচ্ছে সংলাপে, সংস্কৃতিতে, সেমিনারে রাজনীতির কড়া মাঠে, বিশ্বমোড়লের উঠোনে, গবেষণাগারে, স্বীকৃতির দপ্তরে, সাহিত্যের অনুষঙ্গে, গানে, কবিতায়, গল্পে এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধে। বৃহৎ বটবৃক্ষের বর্ণনা প্রকাশ পেয়েছে কাব্যানুশীলনেও। কবিদের কাব্যিকশৈলীতে কবিতার মূল বিষয় তিনি। তাদের শাব্দিক যোজনায় তা-ই প্রকাশ পেয়েছে। তর্জনী সংকেতে কেমন দার্শনিকতাবোধ বিদ্যমান ছিল। তার এ দেশপ্রীতি সমাজসচেতনতা অধিকার প্রণেতা রাজনীতি চর্চা দেখে সিদ্ধান্ত দিতে হয় রাজনীতির মাঠে তিনি রাজনীতির কবি। তাই সমকালীন কবিরাও কবিতাকাল রচনা করছেন এবং করে চলছেন। প্রথম কবিতার পাঠ হিসেবে ধরা পড়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের হৃদয় নিংড়ানো কবিতা- 'যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।' এভাবেই স্বাধীনতার মহান নায়ককে নিয়ে কবিতার মহাকাল রচিত হয়ে চলছে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাঁদের কবিতা রয়েছে- অন্নদা শংকর রায়, আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ, শামসুর রাহমান, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, আবুল হোসেন, বেলাল চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মুহম্মদ নুরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী, কাজী রোজী, আবু হাসান শাহরিয়ার, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, গোলাম কিবরিয়া পিনু, ফকির ইলিয়াস প্রমুখ। সবার কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচিত হলেও জনসাধারণের হৃদয় কেড়েছে কয়েজনের কবিতা, বিদেশি কবি- মার্কিন কবি রবার্ট পেইনের দি চর্টাড এন্ড দ্য ডেমড, সালমান রুশদীর মিড নাইট বিলড্রেম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম, জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, ড. কাজুও আজুমা, মার্কিন কবি লোরি এ্যান ওয়ালশ, জার্মান কবি গিয়ার্ড লুইপকে পাঞ্জাব কবি আহমেদ সালিম, বসনিয়া কবি ইভিকা পিচেস্কি, ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ প্রমুখ।
নাগরিক বোধসম্পন্ন কবি শামসুর রাহমান। স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী বিষয়ের প্রতি কবির আকর্ষণের পাশাপাশি স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা। জাতীয় মুক্তি কামনায় যিনি বারবার কারাবরণ করেছেন কিন্তু পিছ পা হননি। প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষায় যার অবদান কোনকালেও ভুলার নয়। যার অস্থিমজ্জায়, ভাষণে, মননে, স্বীকৃতিতে, রাজনীতি মনস্তুতিতে, সত্তার ঘাড়তা ছিল স্বাধীনতা অভিমুখী। এ মহান দূরদর্শী নেতাকে জনতার অগোচরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই পৈশাচিক হত্যাকান্ড সেদিন কেউই মেনে নিতে পারেনি বিশ্বমাঠ, প্রকৃতি জনগণ, গ্রাম নগরের আলো হাওয়া নিঃসঙ্গ, স্তব্দ, পিতাহীন সংসারের অভাব বোধ করতে শুরু করল। সৃজনশিল্পীদের মাঝে এলো আর্তনাদের ছন্দমঞ্জুরি, কবির সৃজনপ্রক্রিয়াও ছিল চোখে পড়ার মতো- লতাগুল্ম বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর/ মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনা বিহ্বল/ ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে/ ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়/ এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু/ তারই কথা বলে;/ কতটি বছর মহানায়কের হত্যার দায় বহন করে আসছিল, ছটপট করছিল কখন ঘাতকে গলায় ঝুলবে অপরাধের রশ্মি কবি তার কবিতায় যে আক্ষেপ রেখে গেলেন- 'ভীষণ অসুস্থ আমি, শ্বাসরোধকারী/ আমার ব্যাধির কথা জানে নীলিমা, পাখির ঝাঁক, গাছগাছালি/ আর জানে ক্ষয়িষ্ণু স্বপ্নসম্ভব'। ছন্দমালা চেতনার প্রত্যয়ে এ মাটি তার দায় শোধ করল কিন্তু কবি সে দায়কে দেখে যেতে পারেননি।
ঐতিহ্য সচেতন ও শেকড়সন্ধানী কবি আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ। তার কবিতার অনুষঙ্গ বাঙালির ইতিহাস সংস্কৃতি সংগ্রাম বিজয় মানবিক চেতনা রয়েছে। কবির একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতি হয়ে এসেছে ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কথা। নান্দনিক শিল্পকুশলতা শিল্পসুলভভাবে হৃদয়গহীনকে স্পর্শ করেছে। এই নানাদিক ভাবনা চোখে পড়ে 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি' কবিতায়। এ কবিতাটি ঐতিহ্যের শব্দ ছবি যা রিপুগুচ্ছকে নাড়া দেয়, যার ভাষণ, দেশপ্রীতি, মুক্তবাক, প্রতিরোধের ভাষা অনেক নিবিড় তার মতো করে আমরা কী চিন্তা করতে পারবো এ ভাবনা পাঠককে সহজেই নিয়ে যায় বোধের গভীরে এবং বুঝাতে সক্ষম হয় সে কিংবদন্তির কথা তিনি কী অন্য কেউ, না; তিনি তো আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর কবিতা আমার দেশ- যদি দেখি- 'আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি / সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভু্যত্থান কবিতা/ সুপুরুষ ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা / জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা / রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা / আমরা কী তার মতো কবিতার কথা বলতে পারব/আমরা কী তার মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারব। কবিতার চরণ আমাদের নিয়ে রিপু থেকে রিপুর সম্মিলিত আশ্রয়ে।'
জীবন বাস্তবতার অনুগত কবি নির্মলেন্দু গুণ। তার রূপসৃষ্টিতে বিচিত্র উপকরণ উপাদান রয়েছে। তিনি প্রেম সমাজ সংস্কৃতি গণমানুষ লোকমানুষ এবং সংগ্রামশীল মানবের চিত্র রূপায়ণে মনযোগী ছিলেন। বলা চলে তিনি অনুসন্ধানী শিল্পী। স্বচ্ছন্দ ও স্বহৃদয়বান কবির চিন্তনে বাংলাদেশ একটিমাত্র শষ্যক্ষেত্র, শষ্যক্ষেত্রের কৃষিযন্ত্র লাঙল, এ বাংলার মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার বীজ মন্ত্রমাঠ করা হয়েছে রেসকোর্স ময়দানে। ৭ মার্চ কানায় কানায় পূর্ণ এমাঠে জনতা নির্বিঘ্নে বসে আছে কখন মঞ্চে দাঁড়াবেন জনতার কবি। তাদের শুনাবেন মুক্তির কথা, বাঁচার কথা বাঁচানোর কথা অধির আগ্রহ ও ভালোবাসা বুকে আগলে দৃষ্টি দিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। কখন তিনি আসবেন। সে চিত্র কবি মনে গেঁথে রচনা করলেন অমর কবিতা- 'স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা / জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা / কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী/ গনসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম / এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ কবি রবীদ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করে রাজনীতির কবিকে তুলে ধরলেন জনতার সম্মুখে। সত্যিই অনন্য বর্ণনা যা ভাব ভাবনাগুচ্ছ গীতময় হয়ে সৃষ্টির মাঝে সত্তার মেলবন্ধন ঘটেছে। পাঠক সহজে চিনে ফেলে কবি ও রাজনীতির কবিকে।
সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক আমাদের স্বাধীনতা, সংগ্রাম, জাতীয় চেতনা, ঐতিহ্য, জনপদ জনগোষ্ঠী, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিজস্ব ভঙ্গিমায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেরণা মুক্তিকামী বাঙালির অনুপ্রভা তাকে টেনেছে তাই এসব প্রসঙ্গকে কবি বারবার তার অনবদ্য উপাদান হিসেবে টেনে আনেন কবিতার শরীরে। তার কবিতা নবমাত্রা অসম্ভব স্বদেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধু শরীরী। দৃষ্টিভঙ্গি, বোধ, উপলব্ধির প্রয়োগভঙ্গি দেখলে সহজেই তা অনুমেয়, তার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা শ্রদ্ধাবোধ গভীরতা সহজেই ধরা পড়ে যখন দেখা যায় তিনি বুঁদ হয়ে আছেন কবিতায় কাব্যনাট্যে এবং উপন্যাস্যে সেখানে নাড়া দিয়ে উঠে বঙ্গবন্ধুর কথা সত্যিই তা ভুলার মতো নয়। জাতীয় জীবনের দুঃসহ সময়রেখায় যখন কবিদের সঙ্গে তুলে ধরেন- ফিরে এসো মুজিবের কণ্ঠস্বরে / রবীন্দ্রনাথের গানে/ নজরুলের আগুনে আবার / ফিরে এসো বাংলাদেশ / আমার মিনতি / ফিরে এসো লোহিত্য নদের কিনারে/ শিকড়সন্ধানী কবি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাকে আঁকড়ে ধরেন এ হিশাব-নিকেশ নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ছাপচিত্র নির্মাণ সম্পূর্ণ তার নিজস্ব। অনুভবে ইতিহাস ঐতিহ্যের ছাপরেখে বিশ্বাস রাখেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি-"এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান/ যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান/ তার ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি / চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।/ (আমার পরিচয়)
রফিক আজাদ ষাটের দশকের ঠিক প্রথম দিকের কবি। যার কবিতা রোমান্টিকতাকে পুঞ্জিত করে সামাজিক রাজনৈতিক অস্তিত্বসংকট ব্যক্তি অভিজ্ঞতার দিকগুলো শিল্পে সফলভাবে উঠে এসেছে। তার শিল্প সৃষ্টির অনন্য কবিতা 'এই সিঁড়ি প্রতীকী ব্যঞ্জনায় স্পষ্ট করে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুর কথা। যিনি নিজের জীবনের চেয়েও এ দেশকে বেশি ভালোবাসতেন মানচিত্র জুড়ে যার শরীর, নিজের জীবনের চেয়েও এ দেশ ছিল দামি। তার বাড়ি থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ছিল মেলবন্ধন। সে মহীরুহকে ধানমন্ডি, ৩২নং বাড়ির সিঁড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কবি মানসতায় অস্তিত্ববাদী দুঃখবোধ ব্যক্ত করেন এভাবে- এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে/ সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে / বত্রিশ নম্বর থেকে / সবুজ রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে। যিনি একটি সবুজ শস্যশ্যামল উর্বর দেশ পেতে টেনেছেন প্রাণের লাগাম, বুকে রক্তের চেয়েও বেশি ছিল স্বপ্ন, দুর্ভাগ্য পীড়িত জাতি তাকেই ভাসালো রক্তগঙ্গায়।
আবেগ অনুভবের কবি মহাদেব সাহা। তার কবিতা সহজ সরল শব্দের গাঁথুনি কিন্তু ভাব অনেক তীব্র ও ঘনীভূত। ১৫ আগস্ট বাঙালির অভিশপ্ত, স্তবকিত দিন। ঘটাঘট নেমে এলো অমাবস্যার মতো অন্ধকার কবি মন যন্ত্রণা কাতর নিমগ্ন বিষণ্ন গুহায়। চরমভাবে বিপন্ন ভাবা কী যাচ্ছে- এ কী ভোর রাত্রির বুকচেরা তারপর সকাল ভাবতেই পারছেন না কবি তাই কালোরাত এবং এলোমেলো এ দিনের বর্ণনাভঙ্গি করেন এভাবে- 'সেই দিনটি কেমন ছিল/কোটি কোটি চন্দ্রভুক অমাবস্যা তাকে গ্রাস করেছিল / রাত্রির চেয়েও অন্ধকার ছিল সেই অভিশপ্ত দিন।'
কাজী রোজীর কবিতা 'ভিন্ন আকাশ খুঁজছি' এ কবিতায় কবি এমন একটি আকাশ চান যেখানে পিতাকে হত্যা করা হয় না। স্বাধীন দেশ যেখানে স্বচ্ছভাবে মিশে আছেন বঙ্গবন্ধু। যাকে ইচ্ছে করলেও মুছা সম্ভব নয় নয়নতারা তার পাহাদার, চিরচেনা মুখ, ভালোবাসার মুখ, শ্রেষ্ঠ সন্তানের মুখ, জনতার মুখ, যে পিতা আছেন স্বচ্ছ আরশিতে ইচ্ছে করলেও মুছে ফেলা সম্ভব নয়। কবিতার ভাষায়-"যেখানে সিঁড়ির দাগে/ জাতির পিতার নাম মুছে দিতে চাইলেও/ স্পষ্ট পৃতিভাত হবে/ স্বচ্ছ আরশিতে রাখা বঙ্গবন্ধুর মুখ" খালেদ হোসাইনের কবিতা 'ঘুম ভাঙ্গে স্বপ্ন ভেঙে যায়' কবিতাটি বাংলার প্রতিচ্ছায়া। সে ছায়ায় ভাঁটফুল, কদম্ব হরিৎ, বসন্ত, পাতিহাঁস, কসুম রেনু অজস্র স্বপ্নের কথা যে স্বপ্ন দেখান বঙ্গবন্ধু দেখে কবি তা বাঙালিরই স্বপ্নের নির্জাস। কিন্তু সব আছে সব চলছে শুধু পিতা অনুপস্থিত। ঘুম ভাঙে স্বপ্নেরা জেগে থাকে দিন চলে যায়। কবি বলেন, চিল ওড়ে, এই বুক যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়ে যায়/ পুকুর শুকিয়ে কাঠতৃষ্ণা নিয়ে তবু জেগে থাকি/ পাতিহাঁস দলবেঁধে ছায়া খোঁজে কিন্তু তুমি নেই/
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতার মহারথ তৈরি হয়েছে এখনো দেশে-বিদেশে কবিরা কবিতা লিখছেন। তা দেখে শুনে পড়ে জেনে অনুমেয় হয় তিনি বিশ্বময় এবং চিরকালীন নেতা।
বাংলাদেশের স্থপতিকে নিয়ে বাংলা সাহিত্য শাখায় অসংখ্য সাহিত্য চর্চা করা হয়েছে। যদি কাব্যসাহিত্যের কথা বলি তার হিশেব অগণিত। বেবী মওদুদের সম্পাদিত গ্রন্থ। মুজিব মঙ্গল বিশাকা প্রকাশন, সুমন্ত রায়ের ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিবেদিত শ্রেষ্ঠ কবিতা, প্রত্যয় জসীম সম্পাদিত দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু, জিনিয়াস প্রকাশনী, মোনায়েম সম্পাদিত 'মুজিব মানে মুক্তি' পারিজাত প্রকাশনী, কাজল রশীদ সম্পাদিত বাংলাদেশের আকাশ, প্রবাশ প্রকাশনী ইত্যাদি। সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রেখে বাংলার প্রবাদ প্রতিমকে নিয়ে চলছে গবেষণা, সংগীত, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, সাহিত্য চর্চার বিশদ অনুসন্ধান। অনেকের কথা ভাব ভাষা ছন্দ জানাটা গুরু দায়িত্ব ছিলো নানাবিধ কারণেই রয়ে গেছেন আলোচনার বাহিরে। আমার বিশ্বাস তারাও ভালো লিখেছেন। জানামাত্রই লিপিগত হবে এ রচনায় কারণ এ দায়বোধটা অন্তর ও রক্তকোষে শিকড়িত।
কবিতায় কবি, দৃঢ় উচ্চারণ কবিদের তাদের প্রতিটি কবিতা ধরা দেয় মুক্তাসম হিরক অতিমূল্যবান খনিজসম্পদের মতো। সত্যিই বিশ্বয়করও বটে তাদের কারো কারো সহজেই ভেসে উঠে সুফিয়া কামালের ডাকিছে তোমারে, সানাউল হকের লোকান্তর, আবুল হোসেনের শিকারের কবিতা, হাসান হাফিজুর রহমানের বীর নেই আছে শহীদ, বেলাল চৌধুরীর রক্তমাখা চরমপত্র, হেলাল হাফিজের নাম ভূমিকায়, সিকদার আমিনুল হকের আত্মজের প্রতি, আসাদ চৌধুরীর দিয়েছিল অসীম আকাশ, গোলাম কিবরিয়া পিনুর হৃদয়ের রজনীগন্ধা, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের-পিতা, কাজী আবু জাফর সিদ্দিকীর- মৃতু্যঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু। এছাড়াও রাশিয়া আমেরিকা ব্রিটেন জার্মানি ও ভারতের সাহিত্যশিল্পী অনুরাগীদের কবিতায় উঠে এসেছে এ মহানায়কের কথা। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, আন্দোলন সংগ্রাম নেতৃত্ব, কারারণ, রাষ্ট্রনায়ক, ১৫ আগস্টের ভয়াবহতা শ্রদ্ধা পরমমমতার স্পর্শে কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে এখনো হচ্ছে। কবি সম্মোধনের বিষয় বিশ্লেষণ করলে জানা যায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম নিউজ উইকস, বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলেছেন, নির্মলেন্দু গুণ অসাধারণভাবে 'স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতায় কবি হিসেবে সম্বোধন করেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় তিনি কবি রাষ্ট্র বাংলাদেশ তার রচিত কবিতা একটি রাষ্ট্র একটি শ্যামল গাঁ, একটি আঙিনা হাজারো বছরের লাঞ্চিত মানুষ, পীড়িত লোকালয়, অধিকারহীন পাড়া, বুবুক্ষজন, ধলিত-মথিত, টিটকারির শিকার, ভাষারহিত সন্তান, অর্থমন্ধায় জর্জরিত, সমাজ কালচারে পিছ পা, মাটিহীন পদচিহ্ন, মৌলিকতা বঞ্চিত প্রাণী বারবার বধের শিকারী সে রাষ্ট্র এবং মানুষকে নিয়ে চিন্তা নয় ঝাঁপিয়ে পড়লেন আত্মশক্তির মাধ্যমে।
সত্যিই কত মমতা পুষলে জীবনের চেয়ে বেশি ভাবা যায়। যার মধ্যে হিম্মত থাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে, সব বিন্ধ্যাচলকে উপড়ে তিনিই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ তার মধ্যে কবিত্বশক্তি ছিল, তাই তিনি কবিতার মতো বাংলাদেশ আনয়ন করলেন কিন্তু দুর্ভাবনার দুঃস্বপ্নের বিষয় সে কবিকে তারা নিঃশ্বেস করে দিলো লজ্জা! লজ্জা! ঢেকে রাখার মতো কী। সময়ের পর সময় এলো বিচার হলো হন্তারকদের কিন্তু কবির জন্য কবিদের যে কবিতা তা চেতনাময় হলো দেখে যেতে পারলেন না সে কবিরা। কখনো নিরব কখনো সরব ভাষায়- দেশের দৌপায়ায়, গ্রাম বাংলার দো-ছিপায়, মঞ্চে চায়ের কাপে, সমুদ্রজয়ে, নদীর পারাপারে, মাঝিমালস্না, কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক, উঠতি ও সময়ের স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশ নামক কবিতার ছন্দগাথা রাজনীতির কবির নাম, যশ ও খ্যাতি। আশাবাদ এবং বিশ্বাস বিশ্বময় কবির নাম ছেয়ে গেছে তা চিরকালীন স্ন্যাপ, উপড়ানোর চেষ্টা বৃথা ও দুঃসাধ্য।