বেসরকারি টিভি চ্যানেল আই-তে প্রতিদিনের অনুষ্ঠান 'মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন'। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধারা পর্যালোচনামূলক কথোপকথনে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানটির বিশেষ এক পর্বে অংশ নেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
নাসির উদ্দীন ইউসুফের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ প্রচারিত হয়। কবির সাক্ষাৎকারসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের রোজনামচা নির্ভর টিভি অনুষ্ঠান 'মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন' আগামী এপ্রিল মাসের গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে। কবি নির্মলেন্দু গুণের বিশেষ সাক্ষাৎকারটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় স্বাধীনতা দিবস বিশেষ আয়োজনে পত্রস্থ হলো...
নাসির উদ্দীন ইউসুফ :১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ আমাদের ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের ষোড়শ দিবস। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫১তম জন্মদিন। সেই দিনটি কি তিনি জন্মদিন হিসেবে পালন করেছিলেন? আমরা দেখি, সেদিন বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, 'আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না এই দুঃখিনী বাংলায়। আমার জন্মদিনই বা কী আর মৃত্যুদিনই বা কী? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্য_ আমি যে তাদেরই লোক।' আর এই দিন চট্টগ্রামে মওলানা ভাসানী বললেন, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার আপসের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। এভাবেই একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে আলোচনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫১তম জন্মদিনে সাদা গাড়িতে প্রতিবাদের কালো পতাকা লাগিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য গেলেন। তখন সকাল ১০টা ৫ মিনিট। সাড়ে ১১টার মধ্যে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, পুলিশ যে মানুষদের হত্যা করছে, সে কারণে তিনি কালো পতাকা লাগিয়ে গেলেন। আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। জনগণের মধ্যে তা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। আজ এতদিন পর, প্রায় ৩৬ বছর পর, বঙ্গবন্ধুর এই জন্মদিনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা কথা বলব।
আমাদের যৌবনের অন্যতম প্রধান কবি, যিনি আমাদের আন্দোলনে-সংগ্রামে, ভালোবাসাতে, এমনকি ঘৃণা প্রকাশ করতে তার কবিতার মধ্য দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন; তার সঙ্গে আমরা আজ '৭১-এ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে স্বাধিকার আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে কথা বলব। তার কাছ থেকে জানব অনেক কিছু। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার বুকের মধ্যে যার কবিতাটি তখন সব সময় উচ্চারিত হতো, সেই 'হুলিয়া' কবিতার কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি কবিতা লিখেছেন অনেক। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার জীবদ্দশায় তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে প্রতিবাদী যে কবিতা তিনি লিখেছিলেন, তা আজও পড়লে আমরা শিহরিত হই।
আমি প্রথমেই গুণদাকে বলব আপনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন এবং সেই সময়ের একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও পথে-ঘাটে-মিছিলে একসঙ্গে কাজ করেছেন। আপনি সেই সময়ের ওপর একটু আলোকপাত করবেন?
নির্মলেন্দু গুণ :আমি প্রথমেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। এমন একজন নেতার জন্মদিন আমরা স্মরণ করছি, যার জন্ম না হলে আমরা যে বাংলাদেশ আজকে পেয়েছি, সে বাংলাদেশ আমরা পেতাম কি-না, এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ তিনি যেভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড জনগণকে উপহার দেওয়ার জন্য ধীরে-ধীরে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেটি আমি খুব গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। আমাদের যে ১২টি মাস আছে তার মধ্যে মার্চ মাসকে আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলছি এই জন্য যে, আমাদের ডিসেম্বরও বিজয় দিবস হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ফেব্রুয়ারি মাসটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মার্চ মাসকে আমি দেখেছি একটি বহুপত্রবিশিষ্ট গাছের মতো। মার্চ গাছ। মার্চ মাসে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পাতা আছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আছে, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আছে, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস আছে, ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রি আছে। ফলে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিন কোনো মাসের মধ্যে আমরা আর কোথাও দেখি না। ফলে এদিক থেকে এটি একটি অনন্য মাস। স্মরণ করুন সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যাকে আমি মনে করি, এটা বাঙালির চিরকালের মেধা-সম্পদ; যেমন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, তেমনি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি_ আমাদের বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষের জন্য একটি কালজয়ী মেধা-সম্পদ। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ভাষণ এটি।
আপনি আমাকে কবি বলে সম্বোধন করেছেন। আমি আসলে আমার ছাত্রজীবনের ওই সময়টায় কবি হয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করছিলাম। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা আর আমার কবি হয়ে ওঠার সংগ্রামটা খুব পাশাপাশি চলছিল। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৬ সালে তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দিলেন, সেই ছয় দফা কর্মসূচি পড়ে আমি কিন্তু আমার চোখের সামনে একটি মুক্তদেশের মুখমণ্ডল দেখতে পাই। স্বাধীন বাংলাদেশের চেহারাটা আমি দেখতে শুরু করি তখন থেকে। তখন আমি ময়মনসিংহে, আনন্দ মোহন কলেজে পড়তাম। আমার কোনো কবি-খ্যাতি ছিল না। আমার বন্ধুমহলেই শুধু কিছুটা কবিখ্যাতি ছিল। আমার বন্ধুদের মধ্যে কিছু ছাত্রনেতা ছিলেন। তারা যখন ছাত্র জনসভায় বক্তৃতা দিতেন, তারা কেউ কেউ কখনও কখনও আমার সদ্যপ্রকাশিত বা রচিত কবিতা উদ্ধৃত করে বক্তৃতা দিতেন।
'প্রেয়সী গো, কোনোদিন চাইনি কিছুই, আজ কিছু রক্ত চাই,
চেয়ে দেখো বাঙালির চোখগুলো রক্তহীন ভীষণ হলুদ'_
এভাবেই আমার বন্ধুরা, ছাত্রলীগের নেতারা বক্তৃতা করতেন। তাদের মধ্যে একজন আছেন, মাসুদ পারভেজ। যিনি পরবর্তী সময়ে সিনেমার নায়ক হয়েছেন। তিনি আমার সহপাঠী। তারপর আমাদের সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্যারের ভাইগ্না আমার সহপাঠী ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার আমার কবিতা ময়মনসিংহে পপুলার করে তুলেছিল। ময়মনসিংহে আমি মোটামুটি কবিই হয়ে গিয়েছিলাম।
ইউসুফ :ঢাকা পর্যন্ত খ্যাতি তখনও ছড়ায়নি?
গুণ :না। পরবর্তীকালে আমার কবিতা ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতা পত্রিকার একুশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যায়। ১৯৬৬ সালে ৭ জুন হরতাল হলো, তখন বঙ্গবন্ধু কারাগারে। সেই হরতালে ১১ জন মারা গেল, তখন আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম সেটি ঢাকার সংবাদে ছাপা হয়েছিল।
ইউসুফ :বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেটিই কি আপনার প্রথম কবিতা?
গুণ :বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তাকে উৎসর্গ করে লেখা আমার প্রথম কবিতাটি ১৯৬৭ সালে ১২ নভেম্বর ঢাকার দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। তার আগে ছয় দফা নিয়ে আমার আরও দুটো কবিতা আছে। একটা হলো_ যেটা বললাম, 'কোন দিন চাইনি কিছু, আজ শুধু রক্ত চাই।' আরেকটির নাম_ সুবর্ণ গোলাপের জন্য।
ইউসুফ :সেটি তো আন্দোলনের কবিতা।
গুণ :আন্দোলনের কবিতাও বটে, আবার বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়ে লেখা কবিতাও বটে। তার নেতৃত্বেই তো এই এত বড় আন্দোলন। আমার কবিতার নায়ক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময়ে যেটা আপনারা দেখেছেন, 'হুলিয়া' কবিতার মধ্যে। সেখানে আমি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছি, 'শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?' এই যে একটা সংশয়, তার মানে হচ্ছে, শেখ মুজিবের ভুল করার ওপর আমাদের ভাগ্য নির্ভর করছে। তিনি যদি সঠিকভাবে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তাহলে আমরা স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে পারব। এই কবিতাটির নাম_ সুবর্ণ গোলাপের জন্য। এটিও সংবাদে প্রকাশিত হয়।
হুলিয়া লেখার সময় আমার মনে হয়েছিল_ তিনি, অর্থাৎ শেখ মুজিব যদি ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সব আয়োজনই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। আমাদের পরম সৌভাগ্য, তিনি ব্যর্থ হননি। তিনি ভুল করেননি। তিনি আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন। তার নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীন হয়েছি। এমনকি তার অনুপস্থিতিতে, তিনি যে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর গ্রেফতারবরণ করার পরও পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে, তার অবর্তমানে কিছুই আটকে থাকেনি। সবাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে। সব কিছু পরিচালিত হয়েছে তারই নামে।
তিনি ওখান থেকে যখন ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি ফিরে এলেন, তার নেতৃত্ব তিনি হারাননি। স্বাধীন বাংলার মানুুষ তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তার সিদ্ধান্ত কোনোটিই আমাদের স্বাধীনতাকে বিলম্বিত করতে পারেনি, ব্যর্থ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর সেই ছয় দফা প্রথমেই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং কবিতা লিখেছিলাম। সেই একটি কবিতা, যারা নাম 'চন্দ্রের সি্নগ্ধতা নয়'। (কবিতাটি কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজে পড়ে শোনান, যা তিনি ছয় দফার শহীদদের উদ্দেশে লিখেছিলেন।)
১৯৬৭ সালের শুরুর দিকে লেখা এই কবিতায় কিন্তু স্বাধীন দেশের কথা আমার মধ্যে চলে এসেছে।
ইউসুফ :আপনার কবিতা বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন, তখন তাকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন। তিনি কবিতাটি পড়েছিলেন আগ্রহের সঙ্গে।
গুণ :হ্যাঁ, তিনি খুব আগ্রহের সঙ্গে আমার কবিতাটি পড়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে খুব ভালো লাগে। তখনকার বিশিষ্ট ছাত্রনেতা লতিফ সিদ্দিকী, উনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি ছিলেন, তিনিই ওই কবিতাটি জেলখানায় বঙ্গবন্ধুকে পড়তে দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর 'সংবাদ'-এ কবিতাটি বেরিয়েছিল। কবিতাটি লেখা কিন্তু আরও আগে। তখন ৮ মে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়েছিলেন ছয় দফার ওপর ভাষণ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার সময়। তার কিছুদিনের মধ্যে আমি কবিতাটি লিখেছিলাম। কিন্তু কবিতাটি প্রকাশ করতে পারছিলাম না। 'ইত্তেফাক' তখন ছয় দফার পক্ষে অবস্থান করার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 'সংবাদ' সবেমাত্র রিট করে মুক্তি পেয়েছে। শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন তার সাহিত্য সম্পাদক। তিনি আমাকে বললেন, দাঁড়াও পরিস্থিতি একটু পর্যবেক্ষণ করে দেখি। সুযোগ পেলেই তোমার কবিতাটি ছেপে দেব। তিনি কবিতাটি দীর্ঘদিন আটকে রেখেছিলেন। একসময় আমি তাকে বললাম, আমি তাহলে কবিতাটি মোনায়েম খানকে উৎসর্গ করে 'পয়গাম' পত্রিকায় ছেপে দেব। এই কথা বলাতে আমার মনে হয় শহীদুল্লা কায়সার একটু ঝুঁকি নিয়েই আমার এই দীর্ঘ কবিতাটি পূর্ণ পৃষ্ঠায় ছেপেছিলেন। 'স্বদেশের মুখে শেফালী পাতায়'। প্রথমে এই কবিতাটির নাম ছিল 'প্রচ্ছদের জন্য'। সেই কবিতাটি বঙ্গবন্ধুর হাতে পেঁৗছায় এবং তিনি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে লেখা এটিই প্রথম কবিতা। ১৯৬৯ সালে রণেশ দাশগুপ্ত জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে বলেছিলেন_ আমার ওই কবিতাটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার কাছে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কবিতাটি তো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝিয়ে বলেন। আপনারা আমাকে তো ঠিক চিনতে পারলেন না, দেখেন, কবি আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছে_ এ কথাটি কিন্তু তিনি বলেছিলেন হাসতে হাসতে।
ইউসুফ :আসলে গুণদা আপনি বেশ সৌভাগ্যবান এবং আপনার পরিশ্রম, আপনার কমিটমেন্টের জায়গাটি খুবই পরিষ্কার। দেশপ্রেম ও মানবমুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা_ সব মিলিয়ে আপনি সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে আপনার কবিতায় তুলে এনেছিলেন। শুধু '৬৭ সালে নয়, পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখেছি, আপনার অনেক লেখাই আছে, এমনকি সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে, আমার এখনও মনে আছে, বঙ্গবন্ধু মারা গেলেন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে। '৭৬ সালে আপনি বাংলা একাডেমিতে যখন সকাল বেলা কবিতাটি পড়তে যান, তার আগেই আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। আপনি বলেছিলেন, আমরা যেন থাকি সবাই। এই কবিতাটি পড়ার পর আমি হয়তো গ্রেফতার হয়ে যেতে পারি। ও রকমই একটা অসাধারণ কবিতা। গুণদা আপনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগের সময় ঢাকায় ছিলেন। সম্ভবত 'পিপলস' পত্রিকায় চাকরি করতেন। আমি একটি ঘটনার কথা শুনেছি। আপনি তৎকালীন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল, এখন যেটি শেরাটন, সেখানে আপনি ভুট্টোর মুখোমুখি হয়েছিলেন।
গুণ :আমি আর হুমায়ুন কবির। হুমায়ুন কবির এসে বলল, চলো ভুট্টোকে জয় বাংলা স্লোগানটা শুনিয়ে আসি। আমার তো হোটেলে যাওয়ার পাস ছিল। কারণ পত্রিকা অফিসে কাজ করি। আর হোটেলে আমাদের যাতায়াত ছিল। হোটেলের সিকিউরিটিরা আমাকে চিনত। ফলে আমাকে আর হুমায়ুন কবিরকে ঢুকতে দিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ভুট্টো যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে লাঞ্চের সময় হোটেলে ফিরে আসবেন ওই সময় আমরা লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে ভুট্টোর সামনে জয় বাংলা স্লোগান দেব। আমরা ঠিক ওই সময়টাকে কাউন্ট করে সেই জায়গাটায় পেঁৗছাই। কিছুক্ষণের মধ্যে ভুট্টো আসেন। চারদিকে তার আর্মস গার্ড ছিল। সময়টা মধ্যাহ্ন। ভুট্টো যখন লিফটের দিকে আসতে থাকেন, তখন আমি ও হুমায়ুন জয় বাংলা বলে স্লোগান দিই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বুকে চারদিক থেকে অস্ত্র চেপে ধরা হয়। আমরা একেবারে ফ্রিজ হয়ে যাই। হাত তুলে মনে হয় স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে যাই।
ইউসুফ :ভুট্টো কী করলেন?
গুণ :ভুট্টোর চোখে আমাদের চোখ পড়ল। ভুট্টো একেবারে ঘাবড়ে গেলেন বলে মনে হলো কিছুটা। যতক্ষণ পর্যন্ত না আর্মিরা তাকে লিফটের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ভুট্টো আমাদের দিকে তাকিয়েই ছিলেন।
ইউসুফ :গুণদা, এখন আমরা আপনার সঙ্গে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে কিছু বলুন।
গুণ :আমি 'পিপলস' পত্রিকায় ছিলাম। তখন ওইখান থেকে সাপ্তাহিক 'গণবাংলা' বলে একটি কাগজ বেরোচ্ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বের হয়। ওটার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ সাহেব। তিনি আমাকে বললেন, চলেন কবি আপনি একটা রিপোর্ট করবেন। আপনি তো বঙ্গবন্ধুর খুব ভক্ত। তার ভাষণ শুনবেন। আমার তো ইচ্ছা, যাবই। হয়তো ওখানে যাওয়ার সুযোগ না পেলে আমি অন্য জনগণের ভেতরে লাখো মানুষের ভিড়ে শুনতাম সে ভাষণ। তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। সেজন্য আমি আনোয়ার জাহিদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা পাশাপাশি দু'জন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। ওই ভাষণটি আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। তখন যে কবিতাটি আমি লিখেছিলাম, সেটি ৭ তারিখেই একটি টেলিগ্রাম সংখ্যায় বেরিয়ে ছিল 'গণবাংলায়'। সেই পত্রিকাগুলো এখন আর পাওয়া যায় না। আমার সংগ্রহে নেই। কী লিখেছিলাম? আমার নিজেরই খুব আগ্রহ, সেই পত্রিকাটি আমি অনেক জায়গায় খুঁজেছি, পাইনি।
ইউসুফ :'কবি আসবে বলে' একটি অসাধারণ কবিতা।
গুণ :আসলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল একটি কবিতা। এই ভাষণটি কাব্যসমৃদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে মার্কিন সাপ্তাহিক 'টাইমস' পত্রিকায় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর 'পয়েট অব পলিটিকস' শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ স্টোরি করেছিল। এমনকি মার্কিনরাও এই ভাষণ স্টাডি করে তার মধ্যে পোয়েট্রির সন্ধান পেয়েছিল। সুতরাং আমার মনে হয়, ৭ মার্চকে নিয়ে আমাদের যে কবিরা কবিতা লেখেননি, এর মধ্যে এটি একটি কারণ। এই ভাষণটি নিজেই একটি পোয়েট্রি। এখানে ১০৩টি লাইন আছে। ১৯ মিনিটের দীর্ঘ। পরবর্তী সময়ে যে ভাষণটি সিডি আকারে বেরিয়েছে, তার মধ্যে কিছু কিছু শব্দের এদিক-ওদিক পাওয়া যায়। সেই ভাষণটি তিনি এমন চমৎকারভাবে দিয়েছিলেন। প্রথমেই 'ভায়েরা আমার' বলে যে সম্বোধন করলেন। মনে হলো যেন হাজার বছরের বাঙালির যে ভালোবাসার তৃষ্ণা এবং যে প্রত্যয় নির্ভরতা, যার স্বপ্ন দেখেছে সে, সেই নেতা এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। ১০ লাখ লোক একসঙ্গে লাফিয়ে উঠছিল। সব মানুষ যেন আনন্দে উত্তেজনায় একাকার। তাদের নেতার উপস্থিতিতে নিজেদের শক্তির প্রদর্শন করছিল তারা।
এই ঘটনাগুলো কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নেতা হিসেবে সেখানে নতুনভাবে পরিচিত করেছে। তার অভিজ্ঞতাই ভাষণটাকে বিন্যস্ত করতে সাহায্য করেছে। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু যেভাবে ভেবেছিলেন, এই জনতার মধ্যে উপস্থিত হওয়ার পর আমি তোফায়েল আহমেদের কাছ থেকে শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর মুজিব নাকি সারারাত ঘুমাতে পারেননি। কী বলবেন পাঁয়চারি করছিলেন? তখন বেগম মুজিবকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি কী বলব? তখন বেগম মুজিব তাকে একটি ভালো কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি আপনার জনতার মাঝখানে যান, আপনার সমর্থকদের কাছে যান। সেখানে গেলে আপনার মনে যে ভাবনা আসে, সেই ভাবনাটাই আপনি প্রকাশ করবেন। ফলে বঙ্গবন্ধু আগে যে প্রিপারেশনটা নিয়েছিলেন বা হাইকমান্ড থেকে যেভাবে ড্রাফট করা হয়েছিল, তিনি সেইভাবে কিন্তু তার ভাষণটি দেননি। এটি একটি অবিস্মরণীয় ভাষণ। এ রকম ভাষণ আমি আর কারও কাছ থেকেই শুনিনি। এমনকি লেনিন, নেতাজী...আমি লেনিনেরও খুব ভক্ত; কিন্তু তাদের ভাষণ শুনে এ রকম উদ্বেলিত হই না।
ইউসুফ :তাহলে কবিতাটা শুনি, 'কখন আসবে কবি'।
গুণ :এই কবিতাটি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনায় খুবই নগণ্য।
ইউসুফ :তবুও তার জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যদি শোনান।
গুণ :কবিতাটি হলো_ 'স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো'। [কবিতাটি কবি আবৃত্তি করে শোনান।] হ