বেলাল সাইফুল
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মদিন আজ। বাঙালির দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি অজর অমর অক্ষয়। ইতিহাসের পাতায় তাঁর স্থান মহিমান্বিত গৌরবে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। তাঁর সংগ্রাম, তাঁর দূরদর্শিতার জন্য বাঙালি পেয়েছে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। আর তাই তাঁকে নিয়ে যতো কবিতা, গল্প উপন্যাস, ছড়া ও গান প্রভৃতি রচিত হয়েছে, পৃথিবীর আর কোনো নেতাকে নিয়ে তা হয়নি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কবি-সাহিত্যিক তাদের লেখায় বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্থান দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলোতে শুধু ব্যক্তি মুজিবই প্রতিফলিত হয়নি, কোনো কোনো কবিতা সময়কে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুকে করে তুলেছে কালাতিক্রমী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছেন, ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি/আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’ এই গান বাঙালির হৃদয়ে যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছিলো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিলো, যা ছিলো অবিস্মরণীয়। আর অন্নদাশংকর রায়ের কবিতা তো বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। তাঁর ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান/দিকে দিকে আজ অশ্রæগঙ্গা/রক্তগঙ্গা বহমান/নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/জয় মুজিবুর রহমান।’ আমাদের জীবনে অনুপ্রেরণা ও শক্তি জুগিয়ে যাবে অনন্তকাল।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে চিত্রিত করেছেন এভাবে, ‘আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি/সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা/সুপুরুষ ভালোবাসার সুকণ্ঠ-সংগীত কবিতা/জিহŸায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্তশব্দ কবিতা/রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা/আমরা কি তাঁর মতো কবিতার কথা বলতে পারবো/আমরা কি তাঁর মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো?’
সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি তো এখন নিত্যউচ্চার্য পংক্তিমালায় পরিণত হয়েছে। কবিতায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান?’ শামসুর রাহমানের ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভ‚মিকা উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন- ‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পতাকার মতো/দুলতে থাকে।’
কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ প্রভৃতি কবিতা লিখেছেন।
নির্মলেন্দু গুণের লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে ‘স্বাধীনতা- এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পশ্চিবঙ্গের কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশ মুজিব যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য।’
মহাদেব সাহা লিখেছিলেন একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’? তাতে তিনি বলেছেন, ‘তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিনবাদক/বাংলাদেশ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল/আমি আমার দুপকেট থেকে ভাঁজ করা একখানি দশ টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম/বলেছিলাম, দেখো এই বাংলাদেশ।’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসীম সাহার প্রথম কবিতা ‘প্রতিশোধ’। এরপর তিনি একে এক লেখেন ‘আমাদের রাজকুমার ও বাংলাদেশ’, ‘তাঁর নিজস্ব গন্তব্যে’, ‘যদি রাজদÐ দাও’সহ আরো অনেক কবিতা। তাঁর বিখ্যাত পংক্তি ‘পিতা হতে পারে, অবৈধ, আপবাদী/জন্ম কি তবু অবৈধ হতে পারে?/যার দেহে এই পৃথিবীতে পরিচয়/সে আমার পিতা/আমারই রক্তে বাড়ে।’ কিংবা ‘যতোদিন’ কবিতার ‘যতোদিন এই দেশমাটি আছে/আছে নদী মধুমতি/ততোদিন জাতি শ্রদ্ধা জানাবে/জনক তোমার প্রতি।’ এছাড়াও জসীম উদদীন, সুফিয়া কামাল, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, হাসান হাফিজুর রহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবুল হোসেন, রোকনুজ্জামান খান, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, রুবী রহমান, মুহম্মদ নুরুল হুদা, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কাজী রোজী, নাসির আহমেদ, অঞ্জনা সাহাসহ অনেক বিখ্যাত কবির কবিতায় বঙ্গবন্ধু চিত্রিত হয়েছেন তার আকাশচুম্বী মহিমা নিয়ে।