মাহবুব হাসান
শোকের মাস । জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে শোকের কর্মসূচির মাধ্যমে পুরো মাস তাকে স্মরণ করে। পথে-ঘাটে-পাড়া-মহল্লায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান, মিছিল-স্লোগান ও তার ভাষণ শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু জাতীয় জীবনে তার আদর্শের চর্চা চোখে পড়ে খুব কমই।
ইদানীং মিছিল-স্লোগানে একটি বাক্য প্রায়ই শোনা যায়, স্বাধীনতার অপর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ রকম কত নামেই না শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকা যায়। তার বাবা-মায়ের আদরের ডাক ‘খোকা’, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা’, ‘জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বাংলাদেশের জনক’সহ আরও অনেক নামে। কিন্তু সার্বিকভাবে তিনি একটি আদর্শের নাম। যে আদর্শে উদ্ভূত হয়ে বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বিশ্বের বুকে জন্ম দিয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরেকটি নিয়মিত স্লোগান হল- ‘মুজিব আমার চেতনা, মুজিব আমার বিশ্বাস’। কিন্তু প্রায়োগিক জীবনে এ চেতনা আর বিশ্বাসের অভাব অহরহই দেখা যায়।
আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। বাঙালি জাতিকে দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে। আর এসব করতে গিয়ে তিনি যা যা করেছেন, সেটাই তার আদর্শ। এ আদর্শের মূল কথা ত্যাগ আর সংগ্রাম। যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ, লোভ, মোহ, পদ-পদবির ঊর্ধ্বে উঠে নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের বদলে এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তার লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে আমরা দেখতে পাই, তিনি কখনও ক্ষমতার পেছনে দৌড়াননি। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত-উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। আর তাতে অবিচল থেকে তিনি সমসাময়িক আরও অনেক বড় রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা যায় এভাবে- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়া, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-প্রগতিশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলা আর মানুষের জন্য ভালোবাসা। আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনা, সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের জনগণের সেবকে পরিণত করা, স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করা, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, অন্যায়ের সঙ্গে আপোস না করা, দেশ কি দিল সেটা না ভেবে দেশকে কী দিলাম নিশ্চিত করা, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, যা অন্যের স্বাধীনতা বিনষ্ট না করে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নিচের দিকে তাকিয়ে চলা যাতে হোঁচট না খেতে হয়। বঙ্গবন্ধু তার সারাজীবনে এসব কাজের মাধ্যমে-আচরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের পদ নিয়ে ত্যাগের রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। যেটা শুধু তার নির্লোভ মানসিকতাই নয়, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ এবং রাজনীতি ও মানুষের প্রতি কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় তুলে ধরে।
বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ত্যাগের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হল- ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ডাকা ধর্মঘটে নেতৃত্বদানের অভিযোগে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফেরত পাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় তাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। এদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পারা সবসময়ই সম্মান ও গর্বের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রায় সব ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন। কিন্তু নিজের বিশ্বাস ও কাজে আস্থাশীল ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু মুচলেকা দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব ফেরত নেননি।
জাতির জনক গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপস করেননি বলেই তার জীবদ্দশায় তাকে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। অথচ পাকিস্তানি শাসকদের লোভনীয় প্রস্তাব মেনে নিয়ে তিনি অনায়াসেই বড় পদ নিয়ে আরাম-আয়েশে বিলাসী জীবন-যাপন করতে পারতেন। কিন্তু আজ এই ত্যাগ, মানুষের জন্য ভালোবাসা, বৈষম্যহীন সমাজের চিন্তা সুদূরপরাহত। তার দলীয় নেতাকর্মীরাই সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সমাজ ও রাজনীতিতে তার আদর্শ লালন নিয়ে খইয়ের মতো বুলি ফোটে কিন্তু চর্চার বেলায় তা অনুপস্থিত।
যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি, সেই নেতাকে দেখে বিশ্ব দিয়েছিল অভূতপূর্ব কিছু বিশেষণ। তাকে নিয়ে কিউবার প্রখ্যাত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করেছিল ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ নামে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা মন্তব্য করেছিল ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’
বেদনাবিধুর আগস্টে চলার পথে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, তাকে নিয়ে রচিত গান-কবিতা কিংবা স্লোগান চোখে পড়বে চারদিকে। কিন্তু আমরা যদি তার দেখানো পথ অনুযায়ী রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারি, ভোগে নয় ত্যাগে বিশ্বাস করি, তার বিশ্বাস ও কর্মকে লালন করি, তাহলে সেটাই হবে তার প্রতি সত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন।