ফরিদ আহমদ দুলাল
বাঙালির হাজার বছরের শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-ক্রীড়া-সংস্কৃতি অথবা গ্রামীণ জীবন, যেখানেই ইতিহাস ও প্রত্নবিদের পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে অনুসন্ধান করা যায়; মহাকালের আবর্তে বাঙালির সংগ্রামী জীবনে মহাকাব্যিক দ্যোতনায় নায়োকোচিত সৌর্য-বীর্য আর দীপ্যমান ঔজ্জ্বল্য নিয়ে যে বাঙালি মহানায়ক অনিবার্য ভাস্বর হয়ে ওঠেন, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের অপরিসর যাপিত জীবনে বড় মাপের মানুষ যত প্রত্যক্ষ করেছি সামনা-সামনি অথবা পত্রপত্রিকায়, যাদের জীবন পাঠের সুযোগ পেয়েছি, তাতে নিজের সাথে পরামর্শ করে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি বঙ্গবন্ধুর যাপিত জীবন, বেড়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া, বাঙালির জন্য তাঁর আপোশহীন সংগ্রাম এবং তাঁর প্রয়াণ—সব কিছুর মধ্যে রয়েছে মহাকাব্যিক দ্যুতির ব্যাঞ্জনা। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সেই মহাকাব্যিক দ্যুতিতে যদি কেউ নিজেকে আলোকিত করে নিতে পারেন তাহলে তার নিজের ভেতরের কিছু অন্ধকার অনায়াসেই দূর করে নিতে পারবেন।
সাহিত্যে মহাকাব্য রচনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বহুকাল, এ কথা বিভিন্নভাবে বহুবার শুনেছি, পড়েছি। সে অর্থে আজ আর কেউ মহাকাব্য লিখবার চেষ্টা করছেন শুনি না; এমন কী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল কখনো মহাকাব্য লিখবার পরিকল্পনা করেছেন বলে শুনিনি; কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন পাঠ করি, যখনই তাঁর যাপিত জীবনের নানান প্রসঙ্গের সাথে পরিচিত হই, মনে হয়, এই তো মহাকাব্যের এক যোগ্য নায়কের প্রতিচ্ছবি! কবিতার একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে আমি নিজে নিজে ভিতরে ভিতরে নিজেকে সংগঠিত করছি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক একটি মহাকাব্য রচনা করতে চাই। প্রায় চল্লিশ বছর ধরেই আমি বাঙালির জাতিপিতা মহান নেতা শেখ মুজিবকে পাঠ করছি। তাঁকে পাঠ করে বারবার মনে হয়েছে, যে জীবন মহাকাব্যিক ব্যাঞ্জনায় উদ্ভাসিত তাকে কী ক্ষুদ্র গন্ডিতে আবদ্ধ করা যায়? বৃহদায়তনের জীবনকে বিস্তৃত কলেবরেই আলোকিত করা উচিত; যে বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মহৎ মহাকাব্য একটি রচিত হওয়াই সঙ্গত।
অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গদ্য আর কবিতা কম লেখা হয়; আরও হবে এবং হতেই থাকবে। যতদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু উচ্চারিত হবেন প্রতিদিন। পোস্টারে-ফেস্টুনে-ব্যানারে লেখা হবে, “মুজিব আদর্শ অনিঃশেষ/ মুজিব মানেই বাংলাদেশ”। বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল প্রায় সকল কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন; যে দু’চারজন অবস্থানগত কারণে অথবা নিজের সীমাবদ্ধতাবশত লেখেননি, হয়তো তারাও গোপনে লিখেছেন; কবিদের মধ্যে যাঁরা বাঙালি হয়েও জাতিপিতাকে নিয়ে কবিতা লিখেন নি, তারা বঞ্চিত হবেনÑতারা পরিত্যক্ত হবেন। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে পশ্চিমবঙ্গের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭১-এ যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তা এক কথায় অবিস্মরণীয়। অন্নদাশঙ্কর রায়, বাংলাদেশের মানুষ তাকে মনে রাখবে তার অমর সৃষ্টি, নিচের কবিতাটির জন্যে-
যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার, শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।
অমর এই কবিতাটির জন্মকাহিনি বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “একাত্তর সালের মাঝামাঝি একদিন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসে বললেন, ‘খবর পাওয়া যাচ্ছে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলখানায় হত্যা করবে। আমরা গড়ের মাঠে প্রতিবাদ সভা ডেকেছি। অপনাকেও যেতে হবে।’ নির্দিষ্ট দিন গড়ের মাঠে গিয়ে দেখি লোকের ভিড়ে প্রবেশপথ বন্ধ। বাড়ি ফিরে আসি। অগত্যা আমার বক্তব্যকে কবিতায় রূপ দেই।…..আমি যখন এ কবিতাটি লিখি তখন আমার আশঙ্কা ছিল যে, শেখ সাহেব পাকিস্তানি জল্লাদদের দ্বারা নিহত হবেন।” অন্নদাশঙ্কর রায়ের বক্তব্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব এবং সাধারণের আগ্রহের একটা চিত্র ফুটে ওঠে। প্রতিটি কবিতার এমনি জন্মকথা আছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইতোমধ্যেই কয়েক সহস্র কবিতা লেখা হয়েছে। এসব কবিতার কোনো কোনোটি নিজেই একটি মহাকাব্যের শক্তি ধরে। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশকিছু উত্তীর্ণ কবিতা লিখেছেন আমরা জানি। ১৫ই আগস্টের শোকার্ত রাতের ঘটনা নিয়ে তার লেখা ‘সে রাত্রির কল্পকাহিনী’ যেমন আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় তেমনি ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীকরে আমাদের হলো’ কবিতাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নানান কারণে বেশি; আমরা দেখিছি এই একটি কবিতা দিয়ে সারা দেশের মানুষ কী করে বঙ্গবন্ধুর দিকে পুনর্বার মুখ ফিরিয়েছে। নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতার কয়েকটি চরণ:
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন,
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
(স্বাধীনতা-এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হল \ নির্মলেন্দু গুণ)
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কিছু উত্তীর্ণ কবিতা সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকও লিখেছেন, তার ‘পিতার প্রতি’ শিরোনামের কবিতাটির কথা মনে পড়ছে, অসাধারণ একটি কবিতা। আমরা এখানে সৈয়দ শামসুল হক-এর অন্য একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি উদ্ধার করছি:
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের
কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস,
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ,
একই হাসিমুখে বাজিয়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস,
আপস করি নি কখনোই আমি এই হলো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান,
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।
(আমার পরিচয় \ সৈয়দ শামসুল হক)
বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ নিয়ে কবি মহাদেব সাহাও কবিতা লিখেছেন। এখানে মহাদেব সাহার কবিতা থেকে সামান্য কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করছি:
তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা
তুমি কি তাই টলতে টলতে টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে
বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির উপর পড়ে গিয়েছিলে?
শেখ মুজিব সেই ছবির ভিতর এতোক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে
মনে হলো এবার ঘুমিয়ে পড়তে চান
আর কিছুই জানতে চান না তিনি;
তবু শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাকে আমার বলতে
ইচ্ছে করছিলো
সারা বাংলায় তোমার সমান উচ্চতার আর কোনো
লোক দেখিনি আমি।
তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিন-বাদক
বাংলাদেশ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলো
আমি আমার বুক-পকেট থেকে ভাঁজ-করা একখানি দশ
টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম
বলেছিলাম, দেখো এই বাংলাদেশ;
এর বেশি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না!
আমি কি বলতে পেরেছিলাম, তার শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার
আগে আমি কি বলতে পেরেছিলাম?
(আমি কি বলতে পেরেছিলাম \ মহাদেব সাহা)
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘মুজিববাড়ি’ এবং ‘জাতিপিতা ও অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে পৃথক দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন; যদিও তিনি কোন মহাকাব্য লিখবার চেষ্টা করেননি। মুহম্মদ নূরুল হুদার মুজিববাড়ি কাব্য থেকে কয়েক পংক্তি উদ্ধার করছি পাঠকের জন্য:
এখনো যাওনি তুমি বত্রিশ নম্বরে?
হয়তো হবে না যাওয়া, হয়তো-বা হবে।
খাঁচার অচিন পাখি খুঁজি না খাঁচায়,
খুঁজি তাকে অনন্ত অম্বরে।
বত্রিশ নম্বর শুধু বত্রিশ নম্বরে?
মাথা নাড়ে আঙিনার চিরল শিরীষ।
তোমারও চৌকাঠ দেখি হঠাৎ বত্রিশ।
(বত্রিশ \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
এমনিভাবে আমরা অসংখ্য কবির অগণন কবিতার কথা স্মরণ করতে পারি; কিন্তু আমি সেদিকে যেতে চাই না; আমি এখানে আর মাত্র তিনজন কবির তিনটি কবিতা থেকে কয়েকটি পংক্তি স্মরণ করে আলোচনার বাঁক বদলাবো। প্রথমে স্মরণ করছি জসীম উদ্দীন-এর কবিতা:
মুজিবুর রহমান
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী গান
বঙ্গদেশের এপ্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে
জ্বালায় জ্বলিয়ে মহাকাল ঝঞ্ঝা-অশনি বেয়ে
বিগত দিনের যত অন্যায়, অবিচার ভরা-মার,
হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যের অংগার,
দিনে দিনে হয় বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে
দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিলো প্রকাশের মুখে,
তাহাই যেন বা প্রসূত হয়ে জলন্ত শিখা ধরি
ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি
মুজিবুর রহমান
তবু অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত স্নন।
(বঙ্গবন্ধু \ জসীম উদ্দীন)
মনে পড়ছে কবি শামসু রাহমানের ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতার কথা; মনে পড়ছে আহসান হাবীব, ফয়েজ আহমদ, ওমর আলী, শহীদ কাদরী, সিকদার আমিনুল হক, হুমায়ুন আজাদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শামসুল ইসলাম, অসীম সাহা, শিহাব সরকার, ফারুক মাহমুদ, কামাল চৌধুরী, আসলাম সানী, লুৎফর রহমান রিটনসহ অসংখ্য কবির কবিতার কথা; আমি বরং এখানে জাহিদুল হক-এর কবিতা থেকে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধার করি:
তোমার মহত্ব ছিল উদার দরজা,
ঘাতকেরা অনায়াসে ঢুকে গেছে সেই পথ দিয়ে;
না দারি না রক্ষী আর কামান-বন্দুক
কিংবা পরীখায় ঘেরা ছিল না তোমার ছোট্ট বাড়ি,
সেজন্য ছিল না বিঘ্ন ঘুমে আর স্বপ্নে জাগরণে,
ঊাংলার চাটাই পেতে কাশ্মিরী কার্পেট-শূন্য ঘরে
স্বদেশের সুখ-দুঃখ জনতার হৃদয়স্পন্দন
বুকে নিয়ে, উজ্জ্বল আগামীটাকে কোল বালিশের
মতো দু’উরুতে দৃপ্ত চেপে ধরে তুমি
দিগ্বিজয়ী ঘোড়-সওয়ারের মতো
অজস্র স্বপ্নের মধ্যে ঘুমুতে নিশ্চিন্তে!
(বঙ্গবন্ধু \ জাহিদুল হক)
এভাবেই বাংলাদেশের কবিদের কবিতায় কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর যাপিত জীবন। দিলওয়ার, কায়সুল হক, বেলাল চৌধুরী, আসাদ চৌধরী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, হায়াৎ মামুদ, হায়াৎ সাইফ, রুবী রহমান, কাজী রোজী, আবিদ আজাদ, দাউদ হায়দার, ত্রিদিব দস্তিদার, আসাদ মান্নান, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেনসহ অসংখ্য খ্যাতিমান কবি যেমন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন; তেমনি স্বল্প পরিচিত মেহেদী ইকবাল বা সুদীপ্ত সাইদ-এর মতো কবিরাও কবিতা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। আমি এখানে মেহেদী ইকবালের একটি কবিতা উদ্ধার করছি:
ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ রাতে দূরের স্পষ্ট বাতিঘর তর্জনী
তর্জনী হলো নাবিকের দৃঢ় বাহু, গর্ভস্থ শিশুর সাহসী সঞ্চালন।
তর্জনী মানে ব্রহ্মপুত্রের ফুঁসে ওঠা ঢেউ, তেঁতুলিয়া
থেকে টেকনাফ একটি অভিন্ন স্বপ্নের নাম তর্জনী।
তর্জনী মানে পলাশীর আম্রকানন, সিরাজের করুণ চাহনী
মাস্টার দা, তিতুমীর, ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম। তর্জনী মানে
‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ‘
তর্জনী মানে ছয়দফা, উত্তাল উনসত্তর, জনসমুদ্রে
জেগে ওঠা আশ্চর্য একটি দ্বীপের নাম তর্জনী।
তর্জনী মানে পুঞ্জিভূত সাহস, বিশ্ব মানচিত্রে
অনিবার্য একটি পতাকার নাম
(তর্জনী \ মেহেদী ইকবাল)
এভাবেই হাজার কবির কবিতায় প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু জীবন্ত হয়ে উঠছেন তাঁর দেশের অসহায়-দরিদ্র-ভুখা-নাঙা মানুষের কাছে। যদিও মহাকাব্যের ব্যাঞ্জনাময় মহানায়ককে নিয়ে মহাকাব্য লিখবার উদ্যোগ সেভাবে কেউ নিচ্ছেন না। অনেক বছর আগে কবি-কথাশিল্পী-নাট্যকার আলাউদ্দিন আল আজাদ একটি মহাকাব্য লিখবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কোন একটা ছোটকাগজে ১ম সর্গ প্রকাশিতও হয়েছিলো, আমি পড়েছি। তার সে মহাকাব্যের বিষয় যদ্দুর মনে পড়ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো। ধারণা করি আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর মহাকাব্যটি শেষ করে যেতে পারেন নি। আমাদের কাব্যভুবনে আমার পাঠের অলক্ষে সমকালেও কেউ কেউ নিশ্চয়ই মহাকাব্য রচনার প্রয়াস পেয়েছেন, হয়তো তা সুধিমহলে সে অর্থে আলোচিত-আলোকিত হয়নি। অবশ্য ইতোমধ্যেই আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা দু’টি মহাকাব্যের সন্ধান পেয়েছি, যার একটি লিখেছেন, মোস্তফা তোফায়েল অন্যটি কাইয়ুম নিজামী। প্রথমটির নাম ‘একজন প্রমিথিউজ তিনি’ আর দ্বিতীয়টি ‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’। কাইয়ুম নিজামীর লেখা মহাকাব্যটি পড়ার সুযোগ আমার হয়নি, তবে তার অন্যান্য কিছু কবিতা পড়ে আমার হয়তো একটা ধারণা হয়েছে, তার মহাকাব্যের উচ্চতা কতটা হবে; কিন্তু না পড়ে তো আর তার সম্পর্কে মন্তব্য করার সুযোগ নেই; যে কারণে কাইয়ুম নিজামীর মহাকাব্য ‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ নিজের প্রয়োজনেই পড়ে দেখতে চাই। মোস্তফা তোফায়েল-এর ‘একজন প্রমিথিউজ তিনি’ আমি পড়েছি। সেটি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।
মোস্তফা তোফায়েল-এর ‘একজন প্রমিথিউজ তিনি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭-এ, ২০০৮-এ প্রথম সংস্করণ, ২০১২-তে দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ২০১৫-তে পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
আমরা জানি মহাকাব্যে পুরাণ সম্পৃক্ততা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, মোস্তফা তোফায়েল তাঁর মহাকাব্যের নামকরণেই তাঁর পুরাণ সম্পৃক্ততাকে নিশ্চিত করেছেন পাঠকের কাছে। ‘একজন প্রমিথিউজ তিনি’ মহাকাব্যে বঙ্গবন্ধুকে প্রমিথিউজ-এর সাথে তুলনা করা হয়েছে। আমার জানি প্রমিথিউজ গ্রিক পুরাণের এক বিপ্লবী চরিত্র, টাইটানদের সাথে দেবকুলের কখনোই সুসম্পর্ক ছিলো না। প্রমিথিউজ মানুষের কল্যাণে দেবরাজ জিউসের সাথে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। প্রমিথিউজ যখন তাঁর ভবিষ্যৎ দৃষ্টি দিয়ে জানতে পারেন, জিউস মানবজাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করছেন, তখন তিনি মানুষকে শক্তিশালী করতে অ্যাপোলোর অগ্নিরথ থেকে আগুন চুরি করে এনে আগুনের ব্যবহার শিখিয়ে দেন মানুষকে। ক্ষুব্ধ জিউস এ অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তি দেন প্রমিথিউজকে। ককেসাস পর্বতের চূড়ায় তাঁকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় পাথরের সাথে। দেবরাজ জিউসের ঈগল পাখি প্রতিদিন প্রমিথিউজ-এর যকৃৎ ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে যায়, দিনভর যন্ত্রণা ভোগ করেন প্রমিথিউজ। সন্ধ্যায় ঈগল চলে যায়, রাতে আবার নতুন যকৃৎ তৈরি হয় তাঁর; পরদিন আবার জিউসের ঈগল এসে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় নতুন যকৃৎ। দেবরাজ জিউসের দেয়া এ নিয়তি অনন্তকাল ভোগ করে চলবেন প্রমিথিউজ; কিন্তু ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অমিত সাহসী প্রমিথিউজ জানতেন মানুষকে তিনি যে আগুনের ব্যবহার শিখিয়ে এসেছেন, সেই মানব সন্তানরা তার ইচ্ছা পূর্ণ করবে একদিন, নিশ্চয়ই তারা পালন করবে তাদের পিতৃকৃত্য। গ্রিক পুরাণে আমরা দেখি, একপর্যায়ে বীর হারকিউলিস এসে হত্যা করে জিউসের ঈগল এবং শৃঙ্খলমুক্ত করে প্রমিথিউজকে। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে মোস্তফা তোফায়েল বঙ্গবন্ধুকে গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউজ রূপে দেখতে চেয়েছেন, আর বাংলার মুক্তিসংগ্রামের বীর যোদ্ধাদের হারকিউলিস রূপে দেখেছেন। ‘একজন প্রমিথিউজ তিনি’ কাব্যের তৃতীয় পরিমার্জিত সংস্করণের ফ্ল্যাপ মন্তব্যে কবি মুহস্মদ নূরুল হুদা লিখেছেন, ‘মহাকাব্য ও মহাকবির যুগ অবসিত বলে গণ্য করা হলেও এই যুক্তি যে সর্বাংশে মান্য নয়, মোস্তফা তোফায়েল রচিত ‘একজন প্রমিথিউজ তিনি’ পাঠ করার পর সেই ধারণা আবার নতুন করে পোক্ত হলো। এ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ পাঠ করেও প্রায় অনুরূপ উপলব্ধি হয়েছে আরো অনেক কাব্যবোদ্ধার। প্রফেসর কবীর চৌধুরী বা জ্যোতির্ময় দাশের মতো প্রথিতযশা কাব্য সমালোচকবৃন্দ এই কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।………
‘আবাহনী’ থেকে শুরু করে কালিদাসীয় ‘পূর্বমেঘ’ ‘উত্তরমেঘ’ হয়ে মোট পাঁচ সর্গে বিভক্ত এই কাব্যবর্ণনা জাতিপিতা মুজিব থেকে জাতিপুত্র রাসেলের অবিনাশী পুনর্জন্ম পর্যন্ত এক বিবর্তমান নাট্যবয়ান। তার ভেতরলোকে আছে বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রাম ও তার পরিণত পর্ব মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান।’
প্রথম সংস্করণের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছেন, ‘লেখক তাঁর রচনায় ধ্রুপদী গীতিনাটক এবং মহাকাব্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। প্রাচীন গ্রিক নাটকের ধারায় তিনি তাঁর রচনায় কোরাসকে এনেছেন। এ ছাড়া তিনি দ্রষ্টা এক, দুই ও তিন; ভাষ্যকার এক ও দুই প্রভৃতি চরিত্র নিয়ে এসেছেন, যাদের মাধ্যমে তিনি অতীত ও সমকালের ইতিহাস পাঠকের সামনে পরিবেশন করেছেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে কীভাবে শাসকের বুলেট এক মহান শিক্ষককে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে, কীভাবে পুলিশ ছাত্রমিছিল থেকে আসাদের লাশ ছিনিয়ে নেয়– এসব তথ্য যেমন লেখক পরিবেশন করেছেন তেমনি বঙ্গভূমির অপরূপ সৌন্দর্য এবং ঐশ্বর্যের কথা, আর লুটেরা বণিক ও দস্যুদের কথাও উচ্চারণ করেছেন যথাযথ ভাষায়। ‘অন্যত্র তিনি বলেন, ‘লেখকের এই গ্রন্থ মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। এখানে নারী জাগরণের কথা, ছাত্রসমাজ ও তার নেতৃবৃন্দের কথা, মজলুম জননেতার কথা উঠে এসেছে। আমরা এখানে দেখি, ১৯৭১-এর দেশব্যাপী মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞের ছবি। আমরা প্রমিথিউজ-মুজিবের কণ্ঠে শুনি তার নৃশংস কাহিনী:
“বর্বর পৈশাচিক খুনের তান্ডবে
মেতেছে তৈমুরের আত্মীয়স্বজন।
হালাকু চেঙ্গিস খান হত্যাযজ্ঞে মাতে,
উলঙ্গ অসভ্যতায় মত্ত বেসামাল।”
প্রথম সংস্করণ পাঠের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কবি-প্রাবন্ধিক জ্যোতির্ময় দাশ লিখেছেন, ‘আমি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি মূলত দু’টি কারণে। এক: ধ্রুপদী কাব্যনাটকের আদলে লেখা বইটি ১১২ পৃষ্ঠার এমন এক মহাকাব্য, যে ধারায় বিস্মৃত অতীতে ইউরোপীয় সাহিত্যে এপিকধর্মী রচনা দেখতে পাওয়া যেত। দুই: বর্তমান লেখক ‘প্রমিথিউজ’ নামক এক গ্রিক দেবতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের রচনাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা করে এক অসাধারণ ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় প্রতীক সৃষ্টি করেছেন।’
যে তিনজন মানুষের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা হলো, তাঁদের প্রতি সম্মান রেখে, তাঁদের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করে আমি আমার চারদশককালের স্বপ্ন-পরিকল্পনা থেকে সরে যেতে চাই না। আমার বন্ধু মোস্তফা তোফায়েল-এর লেখা ‘একজন প্রমিথিউজ তিনি’ পাশ্চাত্য রীতির মহাকাব্য, যা গ্রিক রীতির নাট্যধরা অনুসৃত সফল রচনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান, এ দেশের কাদামাটি নদী-জলে সিক্ত তার সর্বাঙ্গ; আমার স্বপ্নের মহাকাব্যটি হতে চায় লোকবাংলার শৈলী আশ্রিত; পুরাণ সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নে বাংলার লোকপুরাণ হবে বঙ্গবন্ধু মহাকাব্যের অনিবার্য অনুষঙ্গ। যেন বাংলাদেশের আপামর গ্রামীণ জনপদ আন্দোলিত হতে পারে তাদের স্বপ্নের মহানায়কের সংগ্রামী জীবনবীক্ষায়।