এ ম আ র মা হ বু ব
মহাকবি এবং মহাকাব্যের নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে আপাত দৃষ্টিতে বলা যায়, মহাকাব্য রচিত হয় মহা বিষয় নিয়ে। উদাহরণ স্বরূপ, মহাজীবনের বিশাল কাহিনী, যুদ্ধ বিগ্রহের স্মরণীয় কাহিনী বা কোনো অবিস্মরণীয় সত্য ঘটনা। ‘মহাকাব্যে কাহিনী বর্ণনার পূর্বে কবি স্রষ্টা বা কাব্য দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে প্রশংসা বা স্তুতি প্রকাশ করেন এবং কাব্য রচনায় তাদের বা তার আশীর্বাদ কামনা করেন। মহাকাব্যের ভাষা হবে গুরুগম্ভীর ও ওজস্বী এবং বীরবস প্রধান উপাদান।’ (সূত্র : বিশ্বসাহিত্যে মহাকাব্য ও মহাকবি- মোহাম্মদ আবু বকর, সাগরদি, চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, এপ্রিল, ২০১৫)।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্বসাহিত্যের প্রথম মহাকাব্যের নাম ‘গিলগামেশ’। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমিয়া ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময়ে ইরাকের এক গ্রন্থাগারে কীলক লিপিতে লেখা প্রায় তিন হাজার ছত্রের এই মহাকাব্যে পাওয়া যায়। জানা যায় ওই সময় উরুক নগরে ‘গিলগামেশ’ নামে এক রাজা ১২৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তার জীবন কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছিল বিশ্বসাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য। পরে মহাকবি হোমার, বাল্মিকী, কালিদাস, ফেরদৌস, দান্তে, আলাউল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কায়কোবাদসহ এ সময়ের মহাকবির নাম শোনা যায়। আমার আলোচ্য বিষয় কবি কাইয়ুম নিজামীর একটি অনবদ্য সৃষ্টি ‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে। আলোচ্য গ্রন্থটি মহাকাব্য কিনা এবং কবি কাইয়ুম নিজামী মহাকবির খেতাবে ভূষিত হবেন কিনা সেটি ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই মানবতা ও রাজনীতির মহাকবিকে নিয়ে মহাকাব্যের আদলে রচিত কাইয়ুম নিজামীর এই অবিস্মরণীয় কাব্যগ্রন্থটি কালের পরিক্রমায় মহাকাব্যের স্থান দখল করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ কাব্যগ্রন্থের কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে যার বলিষ্ঠ, সাহসী ও ত্যাগী নেতৃত্ব তাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য, অবিভাজ্য। বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই রচিত হয়েছে ‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ কাব্যগ্রন্থটি। ৮১১ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি দু’ভাগে বিভক্ত। ৯ থেকে ৪৮০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বংশ পরিচয়, জীবন-কর্ম, রাজনীতি, জীবনাবসানসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে একটি কবিতা। ৫৮১ পৃষ্ঠা থেকে ৮১১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ‘যে ছবি কবিতার কথা বলে’ শিরোনামে রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতাগুচ্ছ। বঙ্গবন্ধুর জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে রচিত কবিতাটি এযাবৎকালে বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত সবচেয়ে বড় কবিতা বলে বিবেচিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এককভাবে একজন কবির রচনায় ৮১১ পৃষ্ঠার বিশাল কাব্যগ্রন্থ নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী ও সাহসী পদক্ষেপ।
মহাকাব্য প্রসঙ্গে পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলে থাকেন, ‘ঐতিহাসিক মহাসত্য ঘটনা নিয়ে রচিত মহাকাব্যে রূপক যা ছদ্মনাম ব্যবহার অনাবশ্যক।’ কাইয়ুম নিজামী উক্ত গ্রন্থে মহাকাব্যের সে নীতিই অনুসরণ করেছেন। মহাকাব্যের নিয়মনীতি মেনেই তিনি তার কবিতায় বীররস, করুণরস ও প্রেমরসের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। এ কাব্যের বহুল প্রচার ও প্রসার ঘটলে এটি বাংলা সাহিত্যের মহাকাব্য হিসেবে এবং কবি কাইয়ুম নিজামী মহাকবি হিসেবে বিবেচিত হবেন। এমনটি না ভাবার কোনো কারণ নেই বলে আমার ধারণা।
কবি তার এ গ্রন্থে সাল, তারিখ উল্লেখসহ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন সঠিক ও সত্য ইতিহাসের আলোকে। কবিতার ছন্দে বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে কোনো কল্পনা বা কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটাননি। আনন্দের সাথে কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে একজন পাঠক পরিপূর্ণ বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারবে। উপলব্ধি করতে পারবে। এখানেই কবি কাইয়ুম নিজামীর সার্থকতা। আলোচ্য গ্রন্থে কাইয়ুম নিজামী শব্দচয়নে কঠিন শব্দ প্রয়োগ না করে সহজ-সরল, সর্বজনবোধগম্য সাধারণ শব্দ প্রয়োগ করেছেন। এখানে কল্পকাহিনীর কোনো স্থান নেই। ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা প্রকৃত নাম, তারিখসহ উল্লেখ করেছেন কাব্যিক ভাষায়। এ মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার আলোকে। এতে কোনো কাল্পনিক, রূপক বা পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্র নেই। যারা এই কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছেন তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, পরিবারের সদস্যরা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। কবিতায় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের পরিপূর্ণ চিত্র এবং জীবনাচার তুলে ধরতে বর্ণিত হয়েছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার প্রকৃতি, সৌন্দর্য, সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চালচিত্র, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধসহ নানা প্রসঙ্গ। এ কাব্যগ্রন্থখানি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর ভক্ত যারা’ তাদের উদ্দেশ্যে। কবিতার শুরু বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বংশ পরিচয় বর্ণনার মধ্য দিয়ে, তিনি বলেন :
‘‘…যেখানে মধুমতি বহমান
অজ পাড়া গাঁয়ে টুঙ্গিপাড়া নাম
গাছের ছায়ায় জিরায় শ্রান্ত কৃষক যেখানে
দক্ষিণা বাতাস খেলে সোনালী ধানে
গায়ের মেঠো পথ চলে গেছে বহুদূরে
দু’পাশে আম কাঁঠাল নারিকেলের সারি
নিত্য চেনা বাংলাদেশ
জন্ম তোমার হে জাতির পিতা
টিনের চালের এক অতি সাধারণ ঘরে।’’
শৈশবের দুরন্তপনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ, শিক্ষা, অসুস্থতা এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে প্রথম দেখা কোনো কিছুই বাদ যায়নি কবিতা থেকে। কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, সাংগঠনিক কার্যক্রম, মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগের নানা ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :
‘‘শেখ মুজিব
সময়ের সাহসী সন্তান
শেখ মুজিবগণ আসেন যুগ যুগ পরে
কোন জাতির ক্রান্তি লগ্নে
ডুবন্ত নৌকার কাণ্ডারী হয়ে’’
দেশভাগের পর ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে অবস্থান, শওকত আলীর সান্নিধ্য, ভাষা আন্দোলনসহ সমকালীন রাজনীতির অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন, ১১ মার্চে পাকিস্তান উত্তর প্রথম হরতালে পিকেটিং করতে যেয়ে গ্রেফতারবরণ, ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সারাদেশের মানুষকে সংগঠিত করার চমৎকার বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে কবিতার ছত্রে ছত্রে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জেলে অনশন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও অন্যায়ের সাথে আপস না করা, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ, জেলজীবনের ইতিহাস যেমন এসেছে, এসেছে নানা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গও। ১৯৫৫ সালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে, ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে, ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা এবং প্রচারে কাণ্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ দফা নিয়ে বলা হয়
‘‘৬ দফাই একমাত্র বাঙালির মুক্তির সনদ
৬ দফার পক্ষে জনমত গঠন অত্যন্ত জরুরি
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন
সমগ্র বাংলায় গণসংযোগ করবেন।”
১৯৬৬ সালের ৮ মে আবার গ্রেফতার, আগরতলা মামলা, গণঅভ্যুত্থান, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধী, গোলটেবিল বৈঠক, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধাচারণ, পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ’ ঘোষণা, ৬ জানুয়ারি, ১৯৭০ পুনরায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া, নির্বাচনে জয়লাভ, ইতিহাসের এইসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরেছেন কাব্যকথায়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে গ্রন্থটিতে এমন সব ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে যা একদিকে আমাদের আন্দোলিত করে আবার অন্যদিকে আবেগাপ্লুত করে তোলে। কাব্যকথায় :
‘‘বক্তৃতা লিখা আছে বুকে
জীবনের কলমে রক্তের কালিতে। ’’
অসহযোগ আন্দোলন, ইয়াহিয়া-বঙ্গবন্ধু আলোচনা অবশেষে স্বাধীনতা ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ এই ছিল বাস্তবতা, প্রকৃত ইতিহাস। কবি বলেন,
‘‘সকলের কণ্ঠে সমবেত আওয়াজ
বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চল, বাংলাদেশ স্বাধীন কর
তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং ২৯ মার্চ তাকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে জেলে রাখা হয়। বাঙালির স্বাধীনতাকে নিশ্চিহ্ন করতে ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট-এর নামে শুরু হয় গণহত্যা। গ্রেফতারের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী। সংগ্রামে বহুত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে আসে আমাদের মহান স্বাধীনতা। পাকিস্তানের কারগারে বন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়, তার কবরও খোঁড়া হয়েছিল। পাকবাহিনীর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশের পবিত্র ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে। বইটিতে এসব ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে চমৎকার কাব্যকথায়, যা পড়লে কখনো রক্ত শিহড়িত হয়, কখনো আবেগতাড়িত হয়ে যেতে হয় আবার কখনো অশ্রæ বিসর্জিত হয়।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সোনার বাংলাদেশ গড়ার আশায় তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পরিবর্তন করে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর দেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। সংবিধান প্রণয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বন্যা-দুর্ভিক্ষ, মোকাবেলা, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যুগন্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশ উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর এই সব ভাবনা, পদক্ষেপ, কার্যক্রম কোনো কিছুই বাদ যায়নি কাইয়ুম নিজামীর কলম থেকে। বাদ যায়নি ‘জুলিওকুরী শান্তি পদক’ প্রাপ্তির কথা, বিভিন্ন বিশ্ব সম্মেলনে অংশগ্রহণের কথা, বিশ্ব নেতাদের সাথে সাক্ষাতের কথা। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির ভাবনা, শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির, সাফল্যগাথা এসেছে বইটির পাতায় পাতায়। কাইয়ুম নিজামীর ঐতিহাসিক এ কাব্যগ্রন্থে বর্ণিত আছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কথা, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির কথা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী সময় ও দৃশ্যের কথা। এই বর্ণনা এমনই শোকগাথা যে কেউ পাঠ করলেই তার চোখে পানি এসে যাবে। ৩২ নম্বর বাড়ির যে সিঁড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনাবসান হয় সেই সিঁড়ির কথা বলতেও তিনি ভুলে যায়নি। তার লেখনীতে উঠে এসেছে ১৫ আগস্টে জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর ঘটনার রক্তাক্ত ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর রক্ত এতো সারা বাংলার মানুষের রক্ত। সে কথাই তিনি বলেছেন কাব্যকথায় :
‘‘লাল টকটকে রক্তে ভেসে গেল সিঁড়ি
রক্তে ভেসে গেল ৩২ নম্বর
রক্তে ভেসে গেল ধানমন্ডি লেক
রক্তে ভেসে গেল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা
রক্তে ভেসে গেল গোটা বাংলাদেশ।’’
টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধু একজন আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, সারাবিশ্বের অহংকার। সাধারণ থেকে হয়েছেন অসাধারণ। মানিক থেকে মুজিবুর রহমান, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের জাতির পিতা। রাজনীতির মহাকবি, মানুষের হৃদয়ের মহাকবি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মহাকবি কাইয়ুম নিজামীর শেষ কথা :
‘‘হে জাতির পিতা
টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার
তুমিই বঙ্গবন্ধু, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
তুমিই জাতির পিতা
তুমি বিশ্ববন্ধু, তুমি টুঙ্গিপাড়ার অহংকার।’’
‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের ৫৮১ পৃষ্ঠা থেকে ৮১১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে ‘যে ছবি কবিতার কথা বলে’ শিরোনামে ৮০টি কবিতাগুচ্ছ। প্রতিটি কবিতায় ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েকটি দুর্লভ ছবি গ্রন্থটিকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। এ অংশের কবিতাগুলোতে বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, উদারতা, সংগ্রামী জীবন যেমন স্থান পেয়েছে তেমনি বঙ্গবন্ধুর মাতা-পিতা, ভাই-বোন ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজন এবং বঙ্গবন্ধু যে সব মহান বিশ্ব নেতাদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন তাদের আত্মকলনও স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম, ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব নিয়ে এ পর্বের কবিতাগুলোর শিরোনাম হলো : তোমার তুলনা তুমি, বন্যপ্রাণী, কঠিন সময়, চিন্তিত মন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বৈষম্য, তোমাকে সালাম, বঙ্গ পিতা, জনতার অভিনন্দন, ২৩ মার্চ ১৯৭১, সহযোদ্ধা রিকশাওয়ালা ভাই, বিজয়ের দিনে, নিদ্রাহীন রজনী, ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, অশ্রæভরা চোখে, কবুতরের ডানা, সাধারণের মাঝে, জ্ঞান অর্জনে বঙ্গবন্ধু, আপনজন, বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর শিশুপ্রীতি, পত্রিকা, এক সাধারণ মানুষ, মনে প্রাণে বাঙালি, পাঠক বঙ্গবন্ধু, রক্তগোলাপ, গরিবের ভালোবাসা, স্মৃতিসৌধ, ইত্যাদি। উপরোক্ত প্রতিটি কবিতায় আমরা একজন মানবিক বঙ্গবন্ধু, আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু এবং অসাধারণ প্রজ্ঞাপূর্ণ রাজনৈতিক বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাব। বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘পিতার পিতা’ কবিতায় তিনি উল্লেখ করেন :
‘মুখে একটা কালো পাইপ
চোখে কালো চশমা
দৃষ্টিতে লাল সবুজের পতাকা
একটি বাংলাদেশ।’’
সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর বাহির-ভিতর, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ সব মিলিয়েই আরেক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কবি কাইয়ুম নিজামী তার কবিতায় সে কথারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন সুনিপুণভাবে। বঙ্গবন্ধুর পিতা, পিতামহ, মাতা, মাতামহ, বঙ্গজননী ফজিলতুন্নেছা মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিকটাত্মীয়সহ বিশ্বনেতৃবৃন্দ এবং নানা অনুষঙ্গ নিয়ে সাজিয়েছেন যে ছবি কবিতার কথা বলে’ অংশটুকু। এ পর্বের শেষাংশে ১৫ আগস্ট এবং ১৫ আগস্টে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মকাহিনী ফুটে উঠেছে কবির দরদী ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনার কথাও বলা হয়েছে ‘আমি শেখ হাসিনা বলছি, এবং আমি শেখ রেহানা বলছি’ শীর্ষক কবিতায়। ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’ কবিতাটির শুরুতে কবি উল্লেখ করেন :
“প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমার
আপনারা আমাকে বঙ্গবন্ধু বলেন
আপনারা আমাকে জাতির পিতা বলেন
কিন্তু আমি সবচেয়ে খুশি হই
যখন আপনারা আমাকে মিয়া ভাই বলে ডাকেন।”
এমনই ছিল বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব ও মানবিকতা। কবিতার শেষে যথার্থই বলেছেন :
‘‘তোমরা আমাকে যদি একটু ভালোবেসে থাক
রক্তে কেনা স্বাধীনতা লাল সবুজের পতাকা
দেখে রেখো।”
মুজিবের মৃত্যু নেই ব্যক্তির মৃত্যু হয়, আদর্শের নয়। ‘মুজিব’ একটি আদর্শের নাম। তিনি চিরকাল বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ের গভীরে। গুটি কতক কুলাঙ্গার মুজিবের দৈহিক মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন তবে তিনি তো সুনিশ্চিতভাবে বিরাজমান বাংলার ঘরে ঘরে, পথে প্রান্তরে।
মানবতা ও রাজনীতির মহা কবিকে নিয়ে রচিত মহাকবি কাইয়ুম নিজামীর মহাকাব্য ‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতার নাম ‘শেখ মুজিব বেঁচে আছেন। অত্যন্ত যথার্থ, প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবতার নিরিখে রচিত এ কবিতায় তিনি বলেন :
‘শেখ মুজিব নেই ৩২ নম্বরে তাতে কি?
শেখ মুজিব বেঁচে আছেন বাংলার ঘরে ঘরে
শেখ মুজিব আছেন
মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে।’
কাইয়ুম নিজামীর এ কাব্যগ্রন্থে উপস্থাপিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শনও জীবনাদর্শ প্রতিনিয়ত প্রবহমান আমাদের চিত্র নীলাবসে। বইটির শেষ কবিতার ছত্রে ছত্রে এ রকম উপলব্ধি কবিকে যেমন মহিমান্বিত করেছে তেমনি বইটি কেউ আমাদের কাব্যগ্রন্থে সুমহান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। বইটি প্রকাশ করেছে জায়েন পাবলিকেশন। প্রকাশক-আফরোজা নিজামী, প্রকাশকাল জুন, ২০১৫, প্রচ্ছদ করেছেন-মো. আব্দুল মাজেদ, মুদ্রণে-তিলোওমা মুদ্রণালয়, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম, স্বত্ব-আফরোজা নিজামী। ৮১১পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে একহাজার দুইশত টাকা মাত্র। বইটি রচনা করতে কবির সময় লেগেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেছেন, প্রচুর বই পড়েছেন এবং কঠোর শ্রম ও সাধনা নিয়োগ করেছেন। আমার মনে হয় বইটির নামকরণও যথার্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জন্মেছেন গোপালগঞ্জের এক প্রত্যন্ত, অখ্যাত জনপদ টুঙ্গিপাড়ায়। কে জানত তখন? তিন দশকের ব্যবধানে টুঙ্গিপাড়া হবে বিশ্বখ্যাত। টুঙ্গিপাড়া নামটি প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হবে বাঙালির হৃদয়ে। বাংলাদেশের হৃদয় এই টুঙ্গিপাড়া থেকেই উঠে এসেছিলেন মহাকালের অমৃত সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৮১১ পৃষ্ঠার কবিতা কেউ লিখেছেন কিনা আসার জানা নেই। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখিত এটাই সবচেয়ে বড় কবিতা। এই সাহসী, শ্রম ও কষ্টসাধ্য এবং অনবদ্য কাজটি করেছেন কবি, কথাশিল্পী কাইয়ুম নিজামী। কাইয়ুম নিজামী কবিতা ও গল্প লিখেন দীর্ঘদিন ধরে। তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ৬৫টি, কাব্যগ্রন্থ ৬টি। এই কথাশিল্পী পেশায় ছিলেন শিক্ষক, বর্তমানে শুধুই সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত। এ কবি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। রাজনীতির সাথেও যুক্ত ছিলেন। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন নানাভাবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শ, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভালোবাসা ও ভালোলাগা ‘আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সৃষ্টি করতে পেরেছেন এমন মহাকাব্য। গ্রন্থের শুরুতে ‘কিছু কথা’ শিরোনামে তিনি বলেন,
‘‘বঙ্গবন্ধুর কারণে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা করি। জাতির পিতাকে ভালোবাসি। তাঁর কথা ভাবতে গেলে এখনো চোখের কোণে অশ্রæ জমা হয়। এ লেখা ভালো-মন্দ কী হয়েছে বুঝতে পারছি না তবে আমার নিজের কাছে খুব খুশি লাগছে। এক অসাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে লিখা খুব কঠিন কাজ। সামান্য চেষ্টা করলাম মাত্র। আমার অক্ষমতাকে ক্ষমা করে আবেগকে গ্রহণ করার বিনীত অনুরোধ করছি।’’
কবির এ আবেগ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই স্মরণীয় মুজিব গাথা, রাজনীতির মহাকবিকে নিয়ে রচনা করেছেন এই মহাকাব্য। এটা সামান্য কাজ নয়। এই অসামান্য ও অবিস্মরণীয় কাজের জন্য কাইয়ুম নিজামী চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাংলার মুক্তিকামী বঙ্গবন্ধুভক্ত মানুষের হৃদয়ে।