আফরোজা জামিল
মানুষকে সাহায্য করতে কোনো সময়ই দ্বিধাবোধ করতেন না তিনি। আর্মিতে যখনই যার সাহায্যের প্রয়োজন হতো, সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিতেন বাবা
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সেদিন ভোরে যখন বাবা চলে গেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের টেলিফোন পেয়ে, সে সময় বুঝিনি তাঁকে আর জীবিত অবস্থায় দেখব না কোনো দিন। মধ্যরাতে যখন দেখলাম বাবাকে, তখন শুধু একটা প্রাণহীন দেহ গাড়িতে শোয়ানো।
স্ত্রী আনজুমান আরা জামিলের সঙ্গে কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
আমার বাবার নাম শহীদ কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ আত্মাহুতি দেন তিনি—এখন এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয়। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজনও নেই। যে বঙ্গবন্ধুর এক ডাকে সাড়া দিয়ে একদিন লাখ লাখ বাঙালি জীবন দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য, সেই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পিছ-পা না হয়ে বীর সৈনিকের দায়িত্ব পালন করে বাঙালি জাতির কলঙ্ক ঘুচিয়েছেন আমার বাবা। তাঁর সন্তান হিসেবে এ জন্য আমি গর্বিত।
বাবার মৃত্যুর পর শুরু হলো আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। মা আনজুমান আরা জামিলকে দেখতাম সারা দিন কাঁদছেন। বাবার চল্লিশার দিন জানতে পারলেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। আট মাস পর আমাদের ছোট বোন কারিশমার জন্ম হলো। এর মধ্যে অনেক চেষ্টাচরিতের পর মা একটা বাসা পেলেন। আমরা উঠলাম সেখানে। আস্তে আস্তে শোক কাটিয়ে উঠে ব্যবসা শুরু করলেন মা। আমরা বড় হতে থাকলাম অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে।
আফরোজা জামিল
জন্মের পর থেকেই বাবাকে খুব ব্যস্তজীবন কাটাতে দেখেছি। চাকরিজীবনে তিনি কাজ করেছেন সেনাবাহিনীর দুটি গোয়েন্দা সংস্থায়। সব কাজেই ছিল বাবার সমান আন্তরিকতা। এককথায় কর্নেল জামিল ছিলেন একজন নিপাট ভদ্রলোক। তবে কাজের ভীষণ চাপ থাকায় বাবা আমাদের পুরোপুরি সময় দিতে পারতেন না। কিন্তু যতটুকু দিতেন, সেটা একেবারে যথার্থ। খুব আদর করতেন আমাদের। মাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁদের দুজনের ছিল প্রেমের বিয়ে। আমার বাবা-মায়ের প্রথম দেখা তাঁদের কাজিনদের বিয়ের সময়। সেখান থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে।
বাবা ছিলেন খুব রোমান্টিক মানুষ। মা-বাবা দুজনই খুব চমৎকার গান গাইতেন—বাবা রবীন্দ্রসংগীত। কিছুদিন দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্র ছিলেন বাবা। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ ও ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’ ছিল তাঁর খুব প্রিয়। অবসরে পছন্দ করতেন অনুকরণ করতে—কে কীভাবে কথা বলে—বিভিন্ন দেশের অ্যাকসেন্ট নকল করতেন। ফটোগ্রাফি ছিল তাঁর প্যাশন। তিনি যখন দশম শ্রেণিতে পড়েন, তখন প্রথম ক্যামেরা হাতে পান। এরপর ১৯৬৩ সালে বেতার প্রশিক্ষণ কোর্স করতে যুক্তরাষ্ট্রে গেলে সবার প্রথমে নিজের জন্য যে জিনিসটি কিনেছিলেন সেটি ইয়াশিকা ম্যাট ক্যামেরা। প্রচুর ছবি তুলেছিলেন ওই ক্যামেরায়।
বাবার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর ছিল। আমি তাঁর লেখা নকল করতাম, যাতে তাঁর মতো সুন্দর হাতের লেখা হয় আমার।
মানুষকে সাহায্য করতে কোনো সময়ই দ্বিধাবোধ করতেন না তিনি। আর্মিতে যখনই যার সাহায্যের প্রয়োজন হতো, সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিতেন বাবা।
তিনি ছিলেন সবার খুব পছন্দের। জামিল বা জামিল ভাই বলতে অজ্ঞান ছিলেন সবাই। বাবার কথা যখনই চিন্তা করি, দেখতে পাই একজন পরিপূর্ণ মানুষের মুখ—নম৶ ব্যবহার, মার্জিত কথাবার্তা, খুব নিয়মতান্ত্রিক কিন্তু অনেক দয়ালু এক মানুষের প্রতিচ্ছবি।
শেষবারের মতো যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে চলে গেলেন, যাওয়ার সময় মাকে বলে গেলেন, ‘আমার মেয়েদের দেখে রেখো।’ বাবা আর ফেরেননি। তবে আজ আমাদের ভালো লাগা এখানেই যে বাবা বীরের মতো লড়েছেন, বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করেননি।
আফরোজা জামিল: কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদের মেয়ে।