বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপারায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা শেখ সাহারা খাতুন যাকে আদর করে ‘খোকা’ বলেও ডাকতেন। তিনি শুধু যে একজন আলাদা স্বতন্ত্রের ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, তিনি যেন একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। একাধারে বিদ্রোহী, অন্যায়ের সাথে আপোষহীন, স্বপ্নের ঠাসা বুননে একজন মানুষ, একজন স্থপতি একটি জাতির। আত্বত্যগি একজন মানুষ, অবিশ্বাস্য সাহসী ও বীরত্বের অপরিসীম একটি পূর্নাঙ্গ ইতিহাসও বলা যায় নির্ধিদ্বায়। আর এর সব কিছুরই স্বাক্ষর রেখেছিলেন বাঙালি, ‘জাতির পিতা’ বলে যাকে আমরা সম্মান জানাই, যাকে সাধারণ মানুষ ‘বঙ্গবন্ধু’ নামীয় ভালোবাসায় সিক্ত একটি নাম উপহার দিয়েছিল সবসময়ের জন্য।

এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর-গিরি ও নদী
ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি
হেরিতে এখনও মানবহৃদয়ে তোমার আসন পাতা
এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা-পিতা-বোন-ভ্রাতা।
-----------ডাকিছে তোমারে / কবি সুফিয়া কামাল


অন্যায়কারী শাসকগোষ্ঠী, অত্যাচারী পাকিস্তানীরা যেখানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সাহস পায়নি। নির্লোভ যে মানুষটিকে কতশত চেষ্টাই না করেছে তারা তাদের পক্ষে নেয়ার জন্য, কতটা অত্যাচারই না সহ্য করতে হয়েছিল যে মানুষটিকে। যিনি কিনা জীবনের সবচেয়ে রঙ্গিন সময় তরুণ বয়সের বেশির ভাগ সময়েই জেলে কাটিয়েছিলেন এ দেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার রক্ষায়। হাসিমুখে বরন করেছিলেন দিনের পর দিন বছরের পর বছর কারাবরন। নিজ মহিমায় উজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু সহজেই মানুষ কে বিশ্বাস করতেন। জীবনের শেষ নিঃশাষ পর্যন্ত তিনি কখনও ভাবেননি বাংগালীদের মধ্যে কেউ তার শত্রু। যে মানুষটি আজীবন বাঙ্গালীর স্বপ্ন প্রতিষ্ঠায় ত্যাগী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। যখন তিনি সব বাধাকে অতিক্রম করে স্বাধীন এবং যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত। ঠিক সময়েরই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালো রাত্রিতে একদল বিপথগামী উচ্চাবিলাসি সেনা কর্মকর্তার তাণ্ডব এবং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র ও রোষানলের স্বীকার হন বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার। মহান মানুষটির হত্যাকাণ্ডে যারাই জড়িত ছিলেন। এ জাতি তাদের ক্ষমা করবে না কোনদিন। ইতিহাসের কুচক্রী নরঘাতকদের তালিকায় ঘৃণার সাথে উচ্চারিত হবে সে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া প্রতিটি হত্যাকারীর নাম। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করে, একে একে যেন কেড়ে নিয়েছিল বাঙ্গালীর স্বপ্ন, আশা,ভালোবাসাকেও। যা কখনও পূরণ হবার নয়।

সেদিন যারা নিহত হয়েছিলেন:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ঘাতকের বুলেট কেড়ে নিয়েছিল তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র শেখ রাসেল, পুত্র শেখ জামাল, পুত্র শেখ কামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল এবং পারভিন জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবি, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, কর্নেল জামিল, রিন্টু খান, সিদ্দিকুর রহমান, সৈয়দ মাহবুবুল হক। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা

"বাঙালী, তুমি কি এতই অবোধ!-তুমি কৃতজ্ঞ হও বাঙালী তুমি কৃতজ্ঞ হও
মিথ্যে বলতে বলতে একদিন টিকটিকির লেজের মত অকস্মাৎ খসে যাবে তোমার জিভ
কারন স্বদেশের সমার্থক নাম আর কিছু নয়-শুধু শেখ মুজিব।"
------------------ইকবাল বাবুলের কবিতা থেকে।

সময় কাউকে কাউকে তৈরি করে মহামানব রূপে, আবার কোন কোন মহামানব সৃষ্টি করে তার যাপিত সময়কে অনন্য ইতিহাস করে । দুই অর্থেই শেখ মুজিব সময়ের এক অনন্য চরিত্র। বিশ্ববিখ্যাত আইনজীবী এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সন্ ম্যাকব্রাইড বলেছিলেন, "বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের আত্মার প্রতীক।"

আনিসুজ্জামানের কলমেই ফিরে দেখি :
"যে-মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সে-মাটির সঙ্গে নিঃশর্ত একাত্মতা বোধ করেছিলেন। প্রবলভাবে ভালোবেসেছিলেন সে-মাটির সন্তানদের। স্বদেশ ও মানুষের প্রতি এ নিখাদ ভালোবাসাই তাঁর জীবনের মূলকথা , তাঁর শক্তি ও দুর্বলতার উৎস। এই ভালোবাসা থেকে দেশ ও জাতির প্রতি নিজ কর্তব্য করে গেছেন তিনি অন্তত তিরিশ বছর ধরে। কখনও জনতার মধ্য দিয়েই পথ করে নিয়ে তিনি গেছেন বক্তৃতার মঞ্চে, ক্ষমতার আসনে, কারাগারের অন্তরালে। কখনও তিনি থেকেছেন অগণিত মানুষের মিছিলের পুরোভাগে, প্রতিবাদে-ক্ষোভে-প্রত্যাশায়-দাবিতে। কখনও পেয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনার ভার, সাফল্যে উল্লসিত- ব্যর্থতার বেদনাহত- গৌরবের উদ্ভাসে দীপ্ত- সমালোচনার বাণে বিদ্ধ- কোলাহল থেকে অকস্মাৎ অন্তর্হিত হয়েছেন নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠের নিভৃতে। বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে থেকেছেন মৃত্যুর অপেক্ষায়। তাঁর অদম্য সাহস ও অকুণ্ঠ আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, মানুষের আপনজন হওয়ার ও তাদের বিশ্বাস অর্জনের পারঙ্গমতা- এসবই তাঁকে ধীরে ধীরে রূপদান করেছিল রাজনৈতিক কর্মী থেকে জননায়কে। নিজের বাঙালীসত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কখনও স্বভাবের প্রেরণায়, কখনো সযত্ন উৎসাহে তার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহবান জানিয়েছিলেন সকলের প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১-এ কার আহবানে কত মানুষের ধারা, দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা, সেকথা লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।"

"পিতার রক্ত হাতে মেখে যারা নাচে,
 পরিচয়হীন সেই সব কালো কীট
 বিপরীত স্রোতে শ্যাওলার মতো বাঁচে।
 অন্ধকারের কালো শেয়ালেরা আজ ঘোরে এই দেশে 
 হাতে ঘাতকের ছুরি, 
 এখানে এখন প্রয়োজন পিতার প্রেমের প্রিয় উত্তর সুরী।
 প্রতিশোধ ছাড়া প্রেমে সব কিছু জয় হয়না কখনো, 
 কেড়ে নিতে হবে চাবি,
 রক্তের ঋণশোধ করে দিতে হবে
 প্রতি ধুলিকনা জানায় প্রবল দাবি।"
 ---------কবি মহাদেব সাহা।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তার নিজস্ব সংস্কৃতি অথবা দেশ নির্ভর পরিচয় নিয়েই বড় হয়ে উঠে অথবা থাকতে চায়। আমাদের ভৌগলিকভাবে সে অধিকারটুকু এমনিতেই অর্জিত হয়ে যায়নি। জাতিগত ভাবে আমরা ১৯৭১ সালের এর আগ পর্যন্ত নিজের মতো করে বলতে পারিনি বিশ্বব্রক্ষান্ডে যে- আমি বাংলাদেশি। এ মাতৃভূমির পরিচয়, যেখানে আমি আমার ভাষায় কথা বলবো, আমি আমার নাগরিক অধিকার নিজের মতো করে উপভোগ করবো। সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মানুষগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু এক অন্যরকম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জন্যে। মাতৃভূমিকে ভালোবাসার অপূর্ব এক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল তৎকালীন এ দেশের আপামর স্বাধীনতাকামী মানুষদের। অত্যাচারী হিংস্র পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছ থেকে অধিকার হিসেবে সে সর্বোচ্চ স্বস্তির জায়গা ‘আমার দেশ বাংলাদেশ’ এই বাক্যটিকে বাঙালীর অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেশপ্রেমের চেতনায় ভরা, নিজস্ব ব্যক্তি স্বতন্ত্রে বলিয়ান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

"বঙ্গবন্ধুর চেতনা অমর, অবিনশ্বর" শিরোনামে প্রবন্ধে বর্ষীয়ার রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ‍‌‌‍'বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, আর তা হচ্ছে বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। তাঁর এই সাধনার শুরু ১৯৪৮ থেকে। ১৯৪৭-এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আমরা বাঙালিরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হব। তাই '৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে তিনি গঠন করেছিলেন ছাত্রলীগ এবং '৪৯-এর জুনের ২৩ তারিখে আওয়ামী লীগ। সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। আমরা আজ বিস্মৃত হয়েছি ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব '৪৮-এর মার্চের ১১ তারিখটি। '৫২-এর পূর্বে '৪৮-এর মার্চ মাসের ১১ তারিখটি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতো। আর এই পর্বের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বয়ং।'


***
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের যাত্রা শুরু ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অন্যতম ঐতিহাসিক দিন। পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র দু’মাসের মাথায় ঐদিন প্রথম “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” দাবিতে দেশব্যাপি পূর্ণ-দিবস হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় সচিবালয় গেটের সামনে এই হরতালের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সে সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের- উদীয়মান ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং আহত অবস্থায় কারাবন্দী হন একই সাথে। যা ইতিহাসের পাতায় আজও স্বর্নারে লেখা আছে।

***
১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির সময় জেলে থাকা সত্ত্বেও সেখানে থেকেই প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু। জেলে থেকেই একটানা তের দিন না খেয়ে অনশন পালন করেন তিনি। জনগন কতৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে ১৯৫৫ সালের ২৫শে আগস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বাঙালীর ইচ্ছের কথা নির্ভয়ে এবং অকপটে বলেছিলেন তিনি। তিনি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন নিজ দেশের মানুষের কল্যাণ আনয়নে। শাসন নির্ভর হিংস্র পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষণে ক্ষণে জাগিয়ে তুলেছিলেন স্বাধীনতাকামী বাংগালীদের। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার স্বপ্নে বিভোর সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর এগিয়ে চলার সংগ্রামে সর্বদা নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি।

***
বাংলা, বাঙালীর কৃষ্টি এবং ইতিহাস রক্ষায় সবার আগে যিনি আন্দোলনে নেমেছেন, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন, “স্যার আপনি দেখবেন ওরা পূর্ববাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটি নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কিনা। এক ইউনিটের প্রস্তাবটা গঠনতন্ত্রে অন্তভুক্ত হতে পারে। আপনারা এই প্রশ্নটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলাভাষাকে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কি হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্নটারই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধেই বা কি ভাবছেন? পূর্ববাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নগুলোর সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে স্থপতি। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাবো তারা যেন আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ অথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।

***
১৯৫৩ সালের এক নির্বাচনী প্রচারনার সফরে শেখ মজিব বলেছিলেন, "হতাশ হবার কিছুই নাই। সংগ্রামে যখন নেমেছি, তখন আমাদের সকলকে সংগ্রাম করেই যেতে হবে। আমাদের সংগ্রামের আসল কাজ হবে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে আওয়ামীলীগের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ করা... মনে রাখবা, জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে গেলে বাংলার স্বাধীনতা আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। একদিন না একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।"
১৯৫৩ সালেই মুজিব লক্ষ স্থির করে ফেলেছিলেন- স্বাধীন বাংলাদেশ। হ্যা, বঞ্চনা, শোষনের কথা মুজিবের সঙ্গে আরো অনেকেই বলেছিলেন, বিশেষ করে মাওলানা ভাসানী। কিন্তু শেষ স্টেশন বাংলাদেশ, একটি সতন্ত্র মানচিত্র- এমন কথা তখন মুজিব ছাড়া কেউ সপ্নেও ভাবেন নি।

***
পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠির বিমাতাসুলভ আচরণ, অব্যাহত অর্থনৈতিক শোসন, জাতিগত নিপিড়ন ও প্রশাসনিক বঞ্চনা পূর্ব পাকিস্থানের জনগনের মনে তীব্র অসন্তোস সৃষ্টি করে। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্থান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্থান ভৌগলিক হতে ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ফলে পূর্বপাকিস্থানের জনগনের মনে নিরপত্তহীনতা তীব্রতর হয়। শোষন বঞ্চনা এবং নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে পরিত্রানের আশায় পূর্ব পাকিস্থানের জনগন উদগ্রিব হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অবহেলা, ঔদাসীন্য ও ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত কর্মসূচি হচ্ছে ছয় দফা। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা তাসখন্দ_উত্তর রাজনীতির গতিধারা নিরূপণের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে যোগদানের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর পেঁৗছেন। পর দিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে 'ছয় দফা' প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পর দিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয় দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিহ্নিত করা হয়। ফলে শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে 'আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি' শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় পরবর্তীতে ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন,- "সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।"

বস্তুত, ছয় দফা ছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার মাধ্যমে কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি তার মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা হয়ে ওঠে ম্যাগনাকার্টা, আংশিক নয়, পূর্ণ স্বাধীনতাই ছিল যার অনিবার্য পরিণতি।

***
১৯৬৯ সালের গনভ্যুত্থানে "আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা" ভেসে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান পরিনত হলেন বঙ্গবন্ধুতে। তখন তিনি বাঙালির প্রিয় একচ্ছত্র নেতা। ছয় দফার যৌক্তিকতা সবাই মেনে নিয়েছে। আগরতলা মামলা দেয়া হয়েছিল মুজিবের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য। শাসকরা ভেবেছিলো, পাকিস্তান কাঠামোয় ভারতের সহায়তায় দেশ ভাগ মুসলমানরা মেনে নেবে না। কিন্তু মুজিবের রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় মানুষ ঘাটি বাঙালি হওয়ার চেষ্টায় শতভাগ সফল হয়েছে।

***
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী স্মরণে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ- মুজিব বলেন, "একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে 'বাংলা' কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। 'একমাত্র বঙ্গোপসাগর' ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নাই। বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও  শের-এ বাংলার অমার্জনীয় অবজ্ঞা প্রদর্শিত হইয়াছে। বাংলার এই দুই কৃতী সন্তান আজ অসহায়ের মত আমাদের মুখের দিকে তাকাইয়া আছেন। এই দুই নেতার মাজারের পার্শে দাড়িয়ে জনগনের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতাছি- 'আজ  হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'

***
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ৪ জুন ১৯৭০ ঘোষণা করেন, 'আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে ৬ দফা প্রোগামের উপর ভোট গ্রহনের জন্য।' পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন তার বক্তব্য অনুসারে বলেন, '৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচন যদি গণ ভোট হয় এবং তা যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থন লাভ না করে তাহলে এই অবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে।' পরবর্তিতে দু'টি নাটকীয় ঘটনায় তাই প্রমাণিত হয়। 
১। নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শপথ নেন যে ছয় দফা প্রস্তাবের ব্যাপারে কোন আপোষ করবেন না। এর মাধ্যমে সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে।
২। বঙ্গবন্ধু সামরিক শাসন অগ্রাহ্য করে একটি প্যরালাল সরকার পরিচালনা করেন। ঢাকায় ন্যাশনাল ব্যাংক বন্ধ করে দিয়ে এর দায়িত্ব অন্যান্য ব্যাংক গুলার উপর নেস্ত করেন। পাকিস্তানি নোটের উপর "স্বাধীন বাংলাদেশ" ছাপ দিয়ে মুজিব স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, অখণ্ড পাকিস্তানে তিনি আর বিশ্বাসী নন।

***
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে সেই প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের কি চিন্তা ভাবনা করেছিলেন সেই প্রসঙ্গে তার জামাতা ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন-
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারী রেসকোর্সে এক জনোসভার আহবান করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেখানে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ শপথ করিয়েছিলেন যেন তারা ছয় দফার প্রতি অনুগত থাকেন। "সেদিন রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধু এক পর্যায়ে গম্ভীর হয়ে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, 'দেশটা স্বাধীন হলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে  কবিগুরুর- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি-- গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহন করো।"

***
সেই ৭ই মার্চের ভাষণ, "এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" যে শুনেছে সে ভাষণ তারই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ। কী ছিল সে ভাষণে? কোনো অজ্ঞাত তথ্য নয়, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘোষণা নয়, ভাষার কোনো কারুকার্য নয়, বলবার কোনো পরিশীলিত ভঙ্গি নয়। তাতে ছিল এ দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের অকথিত বাণীর প্রকাশ, তাদের চেতনার নির্যাস, বক্তব্যের অবিসংবাদিত আন্তরিকতা। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এই আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই তো শত্রুদেশে বন্দী থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রেরণা ছিল সক্রিয়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল সকল্‌ তেমনি প্রবল আকাঙ্খা ছিল তার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলার।

***
মার্চের ২৩ তারিখ ছিল পাকিস্তানের দিবস। অথচ ঐদিন পূর্ব বাংলার সকল বাসসস্তান- অফিসে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসসস্তানের বাইরে হাজারো উৎফুল্ল জনতার উপস্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ছাত্র জনতার মার্চপাস্টে সালাম গ্রহন করেন। নিজ গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ঢাকার রাজপথ পেড়িয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে যান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনার জন্য।

***
স্বাধীনতা-ঘোষণা দেবার অপরাধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১-১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নং বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং ২৬ মার্চ তাকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ জেঃ ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে।
বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন : 

“ This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.”

[অনুবাদ : ‘সম্ভবতঃ এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান জানাচ্ছি তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যাই তোমাদের হাতে আছে তার দ্বারাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ না পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’]

এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ট্রান্সমিটারে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত ঘোষণাটি পাঠান-
'পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ'র নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।'
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতার যন্ত্র মারফত তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। রাতেই এই বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয় গভীর রাতে। শহীদ প্রেসিডেন্ট  শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই নির্দেশ পেয়েছিলেন কর্নেল অলি আহমেদ-এর কাছ  থেকে। 

***
এক সাংবাদিক টিক্কা খানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছিলেন কেন? টিক্কা খান জবাব দিয়েছিলেন, “আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, ‘স্যার, শুনুন! শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। এবং আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। …তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।”  সাংবাদিক জানতে চাইলেন, “তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবও যদি ভারতে যেতেন তবে সেক্ষেত্রে আপনি কি করতেন স্যার?” “আমি খুব ভালো করে জানি মুজিবের মতো একজন নেতা তাঁর জনগণকে পরিত্যাগ করবে না। আমি গোটা ঢাকা শহরে তাঁকে খুঁজে বেড়াতাম এবং একটি বাড়িও তল্লাশির বাইরে রাখতাম না। তাজউদ্দীন অথবা তাঁর মতো অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না। সে কারণেই তাঁরা এত সহজে ঢাকা ছেড়ে যেতে পেরেছিল।”

***
সাংবাদিক শেরিল ডান বলেছেন, “ বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা যিনি, রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে এবং জন্মে একজন পূর্নাংগ বাঙালী। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অসীম। তার কন্ঠ বজ্র কঠিন। তার মোহনীয় ব্যাক্তিত্বে সহজেই আবিষ্ট হয় সাধারন মানুষ। তার সাহস এবং অনুপ্রেরনাশক্তি তাকে এই সময়ের অনন্য সেরামানব এ পরিনত করেছে।” নিউজউইক পত্রিকা তাকে “রাজনীতির কবি” হিসাবে আখ্যায়িত করেছে।

***
বৃটিশ মনিবাধিকার আন্দোলনের নেতা, প্রয়াত লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বলেছিলেন, “ বলতে গেলে, শেখ মুজিব হলেন জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী এবং ডি ভেলেরা এর থেকেও মহান নেতা।”

***
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি শিরোনামে লিখেছেন, "৩০ জুলাই অপারেশন শেষে ১১ আগস্ট জেনেভার Quintrin বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু নামলেন। জেনেভার চিফ অব প্রটোকলকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। দীর্ঘদেহী পুরুষ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র বিমানবন্দরটিকে আলোকিত করে বসে আছেন। আমি বাংলার ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে। গত পাঁচটি বছর তাঁকে দেখেছি টিভিতে সংবাদপত্রে। তাঁকে নিয়ে লেখা শত শত রচনা আমি পড়েছি। সেই বঙ্গবন্ধু বাংলার বীর জাতির জনক আমার সামনে বসে আছেন। তাঁকে দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি কত দিন। অপারেশনের পর তিনি বিশ্রাম নিতে জেনেভায় আসছেন জানার পর থেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি বঙ্গবন্ধুকে রিসিভ করার জন্য। আমার চাকরিজীবনের সেরা ঘটনা অথবা বাঙালি হিসেবে সেরা মুহূর্ত বলতে হবে এটিকে। জেনেভায় না এসে ইউরোপের অন্য কোথাও যেতে পারতেন তিনি। আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিই এ মহান ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ফেলার জন্য। আমার বিহ্বলতা, উচ্ছ্বাস এবং আবেগ আরো ঘনীভূত হলো বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণ 'তুই ওলি না?' প্রজাতন্ত্রের ক্ষুদ্রতম এক কর্মকর্তাকে বঙ্গবন্ধু এক নিমিষে আপন করে নিলেন। আমি সালাম জানিয়ে বললাম, 'স্যার সুইস সরকারের চিফ অব প্রটোকল রবার্ট ভিউ এসেছেন আপনাকে রিসিভ করতে।' তিনি তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কৃতজ্ঞতা জানালেন কষ্ট করে বিমানবন্দরে আসার জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদান এবং বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন দেশের জন্ম দেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু তত দিনে নিজেই একজন স্টেটসম্যান বিশ্ববাসীর কাছে। কোথায় দেশটির অবস্থান তা না জানলেও বিশ্বের মানুষ চিনত শেখ মুজিবকে। আমি দেখলাম প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা একজন আইকনিক মানুষ। তাঁর সবখানে সম্ভ্রান্ত মানসিকতা। আর দুর্বলতা? মানুষকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। তিনি আমাকে 'ওলি' বলে ডাকতেন। জেনেভায় ২২ দিন ছিলেন। অনেক অনেক কথা হয়েছে মহাপুরুষের সঙ্গে। পাকিস্তানের কারাগার, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে। ঋজু এবং স্পষ্ট ছিল তাঁর বোধ-বিশ্বাস। আমি আজও বিশ্বাস করি, তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের সুযোগ পেলে বাংলাদেশও আজ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার কাতারে থাকত। কোনো কোনো স্মৃতি থাকে যা চিরদিন বয়ে বেড়ানোর মতো। কোনো কোনো মানুষ থাকেন যাঁকে দেখলে মনে হবে, তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্যই এত দিন অপেক্ষা করেছি। আমি বলছি বঙ্গবন্ধুকে দেখেই মনে হয়েছে এই মানুষটির জন্ম না হলে বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। এই মানুষটির জন্ম না হলে বাঙালি জাতি পরাধীনতার গ্লানি থেকে কোনো দিন মুক্তি লাভ করত না। আমি জাতির জনকের পা স্পর্শ করে আশীর্বাদ নিয়ে ধন্য হলাম। "

======
শেষ কথা:
======
বাংলা ভাষা থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমৃত্যু আপসহীন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ বাঙ্গালী জাতির আত্মপরিচয় ও আত্মজাগরণের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়কাল। আর এই গৌরবদীপ্ত অধ্যায় এবং সময়কালের ইতিহাস নির্মাতা এবং মহান স্থপতি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তবুও কালের যাত্রায় প্রজন্ম-থেকে প্রজন্ম তা ভুলে যায়, ভুলে যেতে তাদেরকে বাধ্যও করা হয়। কোন কোন সময় এবং কারো কারো শাসনকালে। এটাই জাতির  নিদারুণ ট্র্যাজেডি। তাই কালের যাত্রায় আবার জন্মের প্রয়োজন কিছু অনুসন্ধানী ব্যক্তিত্ব, লেখক এবং গবেষক।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্স জোট নিরপেক্ষ সন্মেলনে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো যার সাথে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন- “ আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়। এভাবেই আমার হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে।”


এই মহান নেতার জীবনকে কোন রং বা বর্ণ মালায় একত্রীকরন করা যায় না। কারন মুজিব তার সৃষ্টির চেয়েও মহান। তিনি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের অনুপ্রেরনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আদর্শ এবং উত্তরাধীকার সংরক্ষণ করা বাঙালীজাতির মহান কর্তব্য। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। জনগণকে আশা এবং ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখা, জনগণের স্বপ্নকে বাস্তবিক রূপ দেয়া, জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে উজাড় করে দেয়া, আমৃত্যু অন্যায়ের সাথে আপোষহীন সে অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মহাপ্রয়াণের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। মাগফেরাত কামনা করছি এই মহান নেতার আত্মার।

SUMMARY

1055-1.jpeg