জীবন কানাই চক্রবর্তী
দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে আজ যিনি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের বিশেষভাবে নিপীড়িত-নির্যাতিত-বঞ্চিত মানুষের হৃদয় কন্দরে ভাস্বর হয়ে আছেন অমরত্বের মহাঐশ্বর্য নিয়ে, যাঁর হৃদয় ছিল আকাশের মতো বিশাল, মানুষের জন্য যাঁর ভালোবাসা ছিল অতল মহাসাগরের মতোই, তিনিই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মৃত্যুহীন প্রাণ নিয়ে খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক, জাতির জনক থেকে বিশ্ব মানবতার মূর্ত প্রতীক হবার দুর্লভ যোগ্যতা অর্জনে তিনি অনন্য, অনুপম; তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজেই।
স্বচক্ষে কবরে জীবনত্দ সমাধিস্থ হবার প্রস্তুতি দেখেও সর্বভয় তুচ্ছ করে তিনি সৎসাহসে বলতে পেরেছেন- সশস্ত্র দুর্ধর্ষ পাকসৈন্যের মুখের উপরে, বাঙলার স্বাধীনতা, বাঙালির মুক্তি, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যই আমার চিরকাম্য। আমি ভয় করি না মৃত্যুকে, ভালবাসি আমার দেশ বাঙলাদেশকে, ভালবাসি শুধু আমার প্রিয় জনগণকে। এই ভালোবাসা থেকে কেউ আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
সর্বভয় তুচ্ছ করে আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তিনি পাকিসত্দানী কারাগারে রুদ্ধ থেকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামে। তাঁর নামেই সংগঠিত হয়েছে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম। মুক্তিসংগ্রামের এই মহান প্রাণ পুরুষের আত্মার প্রতি জানাই আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বিনম্র প্রণতি তাঁর অমর আত্মার প্রতি। কৈশোর থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। একুশের মহান ভাষা আন্দোলন, এ দেশবাসীর স্বাধিকার আন্দোলনসহ মুক্তিসংগ্রাম পর্যনত্দ সকল আন্দোলনেই তিনি ছিলেন অগ্রনায়ক, মহানির্দেশক।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের ভাষা সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে দিয়ে গেছেন গৌরবের শীর্ষস্থান। বঙ্গবন্ধু লেখক ছিলেন না; ছিলেন না কবি; ছিলেন লেখার অমূল্য বিষয় উপাদান।
শুধু বাংলাদেশ, ভারত, পাকিসত্দান অর্থাৎ এই উপমহাদেশের কবি লেখকরাই নয়, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিক বঙ্গবন্ধুর চিরঅমর অক্ষয় অজেয় কীর্তি নিয়ে লিখেছেন অনবদ্য তথ্যসমৃদ্ধ বিপুল পুসত্দক, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ।
মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন-এর দি চার্টার্ড অ্যান্ড দ্য ডেমড্ সালমান রুশদির 'মিড নাইট চিলড্রেন' ও 'শেইম', জাপানি কবি মাতসু শুকইয়া, গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরি অ্যান ওয়ালস, জার্মান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়ার কবি ইভিকা পিচেস্কি, ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ প্রমুখ কবি সাহিত্যিকের নির্মোহ লেখায় চিরভাস্বর হয়ে উঠেছেন রাজনীতির মহাকাব্যের মহাকবি চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা থমাস মেরর- এর 'মুজিবস্ বিভেন্জ ফ্রম দ্য গ্রেভ' পাকিসত্দানী লেখক রাও ফরমান আলির 'ভুট্টো শেখ মুজিব বাংলাদেশ', প্রাণ তিওয়ারির লেখা- 'ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স ইন বাংলাদেশ : স্টাইল অব শেখ মুজিবুর রহমান', রবার্ট পেইন এর- 'পাকিসত্দানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু' (ভাষানত্দরিত নাম), শ্যামল বসুর 'আমি মুজিবর বলছি', অমিতাভ দাশগুঞ্জের 'গতিবেগে চঞ্চল বাংলাদেশ : মুক্তি সৈনিক শেখ মুজিবুর', কৃত্তিবাস ওঝার, 'আমি শেখ মুজিবর বলছি', মনোজ দত্তের 'আমি মুজিবর বলছি'- প্রভৃতি প্রামাণ্য গ্রন্থাবলিতে ইতিহাসের এই মহানায়কের সংগ্রামী জীবনের অনন্য অবদানের কথা বিবৃত হয়েছে বস্তুনিষ্ঠভাবে ু বিসত্দৃতভাবে।
পাঞ্জাবি কবি আহামেদ সালিম 'পাকিসত্দানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দীজীবন' পাঞ্জাবি ভাষায় 'বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক' এবং 'সোনার বাংলা' শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখে পাকিসত্দানী কারাগারে নয় মাস কারারুদ্ধ ছিলেন।
পৃথিবীর কোনো নেতা কোনো দেশে কোনও কালে কি সাহস করে বলতে পরেছেন, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা?- কী অমর দুঃসাহসী উচ্চারণ!
জনগণের নন্দিত-বন্দিত বঙ্গবন্ধু জনগণকে যে কত ভালোবাসতেন তা তাঁর অনত্দরের আকুতিভরা নিম্নের অভিপ্রায়েই প্রকাশ পেয়েছে -
আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। তিনি পরম ধার্মিক হয়েও মা, মাটি আর মানুষের অনত্দরের আকুতিকে প্রকাশ করেছেন নিম্নোক্তভাবে- বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তাঁর ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তাঁর ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তাঁর ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতার কোনো স্থান নাই। ...এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার মাটিতে আর চলবে না। সামপ্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। তাঁর এই বক্তব্যের ধর্মবাণী সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়- ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।
১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি অকুতোভয়ে বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমি প্রধান মন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। ...............এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো-ইনশালস্নাহ।
চির সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর এই মহানির্দেশক অমোঘ বজ্রকণ্ঠের পরে কি আর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রয়োজন থাকে? তবুও কেনো স্বাধীনতার ঘোষণাকারীকে- নিয়ে অবানত্দর প্রশ্ন উঠে, বার বার?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির জনক, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের মহান স্থপতি স্বাধীন স্বার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা তথা স্থপতি। তাঁর জীবনাদর্শের মূল লক্ষ্য ছিল শোষিতের গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক তথা সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না।
ক্লানত্দহীন ব্যবস্থায়, স্বল্প পরিসরের এই লেখায় কেনো, কোনো মহাকাব্যেও শেষ করা যাবে না রাজনীতির মহাকাব্যের এই মহাকবির জীবন-কর্ম-দর্শন তথা পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য।
শুধু গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা করার মতো ক'জন অমর ব্যক্তির চির অমস্নান 'কাব্য-কণিকা' উল্লেখের মাধ্যমে আমার অনত্দর্লোকের অপ্রমেয় শ্রদ্ধা জানায়ে অতৃপ্তচিত্তে শেষ করবো চিরভাস্বর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার আজকের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র লেখাটি।
যতদিন (যতকাল) রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান,
ততদিন (যতকাল) রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
-------অন্নদা শংকর রায়
ওরা তাঁকে হত্যা করে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত ঊর্ণাজালে আর ধোয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশ প্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে, মহা মিছিলের পুরোভাগে।
------শামসুর রাহমান
শোনো একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে উঠে রণি।
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
-----গৌরী প্রসন্ন মজুমদার
আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি, কিন্তু আজ আমার হিমালয় দর্শন হয়েছে।
----বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দর্শন করে কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রো
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।
----জীবন কানাই চক্রবর্তী