মুজিব কারাগারে মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে


করিম আবদুল্লাহ
মুজিব জনতার নেতায় পরিণত হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে। মামলা প্রত্যাহার হওয়ার পর তিনি জেল থেকে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করেন লক্ষ কোটি বাঙালির ঘরে ঘরে। তাঁর এ আনন্দ আগমন অভ্যর্থিত হয়েছিল মিছিলে অংশগ্রহণ করে, উদ্দাম আনন্দ মিছিলের উল্ল্লসিত স্লোগানে। মামলা প্রত্যাহার হওয়ার আনন্দে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল বের হয়েছিল। ঈদের চাঁদ দেখলে শৈশবে যেরকম আনন্দ লাগত, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের খবর শুনে তার চেয়েও বেশি আনন্দ অনুভব করেছিল কামাল। বিকেল বেলায় খবর শোনার পর কামালরা তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দ মিছিল বের করেছিল পাড়ায়। শুরুর দিকে বার চৌদ্দজন ছিল। মিছিলে কখনো ইচ্ছুক হতেন না, এমন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিও সেদিন স্বেচ্ছায় মিছিলে অংশগ্রহণ করে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এই মিছিলের প্রধান স্লোগান ছিল; ‘হই হই মামলা কই’। কামালদের পাড়ায় এই দিনই মিছিলে ‘জয় বাংলা’ স্ল্লোগান প্রথমবারের মতো উচ্চারিত হয়েছিল।
এই ছন্দময় পংক্তিটি বাংলার বাণী পত্রিকার ব্যানার হেড লাইন। হরিণায়, ট্রান্‌জিট ক্যাম্প থেকে সকাল বেলায় প্রশিক্ষণ শিবিরের দিকে যাওয়ার সময় একটি পান-সিগারেটের ঝুপড়ি দোকানের দড়িতে বিক্রির উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখা কিছু পত্রিকার দিকে আকস্মিকভাবে কামালের চোখ যায়। পত্রিকা কেনার কোনোরকম চিন্তা বা ইচ্ছা নিয়ে কামাল ক্যাম্প থেকে বের হয়নি। সে প্রশিক্ষণ শিবিরের দিকে যাচ্ছিল প্রশিক্ষণ কোন দিন থেকে শুরু হবে সে সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে।
কামাল, ২৩ জুন ১৯৭১, দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্‌রুম হয়ে হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছে। আজ ২৮ জুন। পাঁচ দিন হচ্ছে, এখনো প্রশিক্ষণ শুরু হয়নি।
কবিতা পড়তে কামালের ভাল লাগে। তার চেয়েও বেশি ভাল লাগে সংবাদপত্র পড়তে। দৈনিক ইত্তেফাক তার মাথায় পত্রিকা পড়ার পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। পত্রিকার হেড লাইন কবিতা হয়ে ওঠায়, তার চোখে পড়ার সাথে সাথে চুম্বকের মতো তাকে টেনে পত্রিকার দিকে নিয়ে যায়। লাল কালির বিশাল হেড লাইনের কবিতাপত্র হাতে নিয়ে পাঠ করার সময় চেতনার প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে এক চমকিত সত্যের অনুভব বিদ্যুতের শিহরণ হয়ে বেরিয়ে যায়। বার বার পাঠ করায়, হয়ে ওঠে এক দীর্ঘ কবিতা। যতবার পাঠ করে ততবারই নতুন করে অনুভব করে একই রকম শিহরণ। মনে হচ্ছিল কামালের মনের কথা কামালের মন থেকে নিয়ে এ হেড লাইনের ভাবনা রচিত হয়েছে। অনুভবের এ সাদৃস্য বিস্ময়কর! সব মন এখানে একই রকম অনুভবের দোলায় যেন ভাসছে। এ পারে সমবেত প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ের ওপর মুক্ত মুজিবের চেয়ে বন্দি মুজিবের প্রভাব কত তীব্র, গভীর, কত বিচ্ছেদ-বেদনা ভারাক্রান্ত, তার ওজন যেন এই রক্তিম রঙ দিয়েই শুধু মাপা যায়।
লাল ব্যানার হেড লাইনের সীমায় চোখ-মন বন্দি হয়ে যাওয়ায় চোখ সরিয়ে মনকে আর প্রতিবেদনের ভেতর নিয়ে যাওয়া যায় না। এই যুদ্ধক্ষেত্রে মুজিবহীন সময়ে মুজিবের অনুসারীদের হৃদয়ে যে বিচ্ছেদ ভাবনা, যে ক্ষোভ-আক্ষেপ, যে শূন্যতা-রিক্ততা, যে আবেগ-অনুভব, যে প্রচণ্ড শক্তি তরঙ্গ সঞ্চিত-কম্পিত হয়েছে তা যেন এই একটিমাত্র হেড লাইনের মধ্য দিয়ে শতভাবে, সহস্র পঙ্‌তিতে, অজস্র শব্দে ছন্দে ঝংকৃত ও মুখরিত হয়ে উঠেছে।
এ পারে, হরিণায় মুজিবের উপস্থিতি এতো নিবিড়-গভীর, এতো সচল-সরব, এতো উজ্জ্বল-উচ্ছ্বসিত, এতো জীবন্ত-প্রাণময়, মুজিবের এমন প্রবল-প্রখর আবেগতাড়িত সাক্ষাৎ সান্নিধ্য লাভ ওপারে কামালের কখনো ঘটেনি। এখানে যুদ্ধযাত্রায় সমবেত যুবকরা প্রতিদিন তাঁর আবির্ভাব আনন্দে নিমজ্জিত হওয়ার কামনায় উন্মুখ অপেক্ষায় থাকে।
পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবকে সাক্ষাৎ দর্শনের সুযোগ কামালের মাত্র তিনবার হয়েছে। প্রথমবার দেখেছিল ১৯৬৬ সালে। লালদিঘির মাঠের একটি ছোট্ট জনসভায়, শ’তিনেক লোক জমায়েত হয়েছিল এতে। ছোটবেলা থেকে সভা-সমাবেশ ও মেলার প্রতি কামালের ছিল প্রবল আকর্ষণ।
আছরের নামাজের ওয়াক্ত হলে মিটিংয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে নামাজ পড়ার জন্যে উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকরা ওজু করে কাতারবন্দি হতে শুরু করে। এ সময় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। ওজু শেষ করে, সামিয়ানা টাঙানো মঞ্চ থেকে নেমে মুজিব বৃষ্টি ঝরা আকাশের নিচে জনতার কাতারে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর এ কাজটি কিশোর কামালের খুব ভাল লাগে। কামালের জীবনে এটিই ছিল প্রথমবারের মতো দেখা কোন নেতার রাজনৈতিক কারিশমা। কামাল অনেকদিন পর জানতে পেরেছিল; এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের ছয় দফা প্রচারের প্রথম জনসভা।
দ্বিতীয় দফায় দেখেছিল, প্যারেড ময়দানের মঞ্চে, সত্তরের নির্বাচনপূর্ব জনসভায়। লালদিঘির মাঠের মতো কাছে থেকে নয়, অনেক দূর থেকে মুজিবের ডান পাশে আবছা দেখতে পেয়েছিল। তিনশ লোকের জনসভার নেতা তখন লক্ষ জনতার জনসভার নেতায় পরিণত।
ছয় দফা দাবি সব জাতীয়তাবাদী বাঙালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়ে গেছে ততদিনে। লোকে লোকারণ্য প্যারেড ময়দানে স্থান না পেয়ে কামালকে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র হোস্টেলের ছাদে দাঁড়িয়ে মুজিবের বক্তৃতা শুনতে হয়েছিল। এটিই ছিল কামালের জীবনে প্রথমবারের মতো দেখা সত্যিকার বিশাল জনসভা।
মুজিব জনতার নেতায় পরিণত হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে। মামলা প্রত্যাহার হওয়ার পর তিনি জেল থেকে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করেন লক্ষ কোটি বাঙালির ঘরে ঘরে। তাঁর এ আনন্দ আগমন অভ্যর্থিত হয়েছিল মিছিলে অংশগ্রহণ করে, উদ্দাম আনন্দ মিছিলের উল্ল্লসিত স্লোগানে। মামলা প্রত্যাহার হওয়ার আনন্দে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল বের হয়েছিল। ঈদের চাঁদ দেখলে শৈশবে যেরকম আনন্দ লাগত, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের খবর শুনে তার চেয়েও বেশি আনন্দ অনুভব করেছিল কামাল। বিকেল বেলায় খবর শোনার পর কামালরা তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দ মিছিল বের করেছিল পাড়ায়। শুরুর দিকে বার চৌদ্দজন ছিল। মিছিলে কখনো ইচ্ছুক হতেন না, এমন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিও সেদিন স্বেচ্ছায় মিছিলে অংশগ্রহণ করে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এই মিছিলের প্রধান স্লোগান ছিল; ‘হই হই মামলা কই’। কামালদের পাড়ায় এই দিনই মিছিলে ‘জয় বাংলা’ স্ল্লোগান প্রথমবারের মতো উচ্চারিত হয়েছিল।
(২)
হরিণা একটি সবুজ পার্বত্য এলাকা। এখানে কিছু আমলকি গাছেরও দেখা মেলে। মনে হয় একসময় এখানে আমলকি গাছের বন ছিল। চূড়া সমতল করে একটি পাহাড়ের প্রশস্ত ঢালু দেশে বাঁশের ঝলি ও শনের ছাউনি দেয়া ছয়-সাতটি নাতিদীর্ঘ ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে হরিণা ট্রান্‌জিট ক্যাম্প। এ ঘরগুলোর নাম ব্যারাক। ২৫ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের নামে এই ব্যারাকগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। যেমন সার্জেন্ট জহুরুল হক ব্যারাক, শহীদ আসাদ ব্যারাক ইত্যাদি।
ঘরের এক পাশে ইট বিছানো। ইটের উপর ধারা বিছিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্ধ্যা নামলে হারিকেন দিয়ে যান স্বেচ্ছাসেবকরা। ক্যাম্পের প্রবেশ পথে, সামনে যে ব্যারাক ঘর রয়েছে সেটার একটা বড় অংশ নিয়ে রয়েছে প্রশাসনিক অফিস। সেখানে ট্রান্‌জিট ক্যাম্পের স্টুডেন্ট মৌবিলাইজারের দায়িত্ব পালন করছেন হাসেম ভাই- আবু মোহাম্মদ হাসেম। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। কামাল তাঁর বাবা জনাব আবদুল কুদ্দুছ মাস্টারের ঠিক করে দেয়া গাইড নিয়ে রাউজানের মোহাম্মদপুর থেকে ভারতের পথে খাগড়াছড়ির বড়ইতলী পর্যন্ত এসেছে। ট্রান্‌জিট ক্যাম্পের উত্তর পাশে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। দক্ষিণে অনতিদূরে শরণার্থী শিবির পেরিয়ে এখানে আসতে হয়।
২৩ জুন, সন্ধ্যা ৭ টা। এম পি এ জনাব আবদুল ওহাবের সাবরুম অভ্যর্থনা কেন্দ্র হয়ে আজ বিকেল বেলায় কামাল হরিণা ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পথে তিনদিন ধরে হাঁটার ক্লান্তি নিয়ে ব্যারাকে শুয়ে আছে। হঠাৎ মুজিবের কণ্ঠস্বর ব্যারাকের উপর দিয়ে ভেসে যেতে শুনে কামাল চকিত হয়ে ওঠে। মুজিব এখানে কিভাবে এলেন, তিনি তো পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি! এক আচম্বিত গ্রাস করা চাঞ্চল্যের তাড়ণা তাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে দেয়। মুজিব দর্শনের আশায় তাঁর কণ্ঠস্বরের প্রবাহ অনুসরণ করে কামাল ট্রান্‌জিট ক্যাম্পের অফিসের পাশে এসে পৌঁছে। সেখানে কামালের মতো আচানক আকর্ষণের টানে ইতিমধ্যে হাজির হয়েছে আরো দশ-বার জন। দেখতে দেখতে আগন্তুকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সে, অফিসের দরোজায় গিয়ে দেখে সেখানেও শ্রোতায় ভরতি। সবাই মগ্নলীন, এই গিরি দেশের শরীরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসা এক অলৌকিক ভাষণের ছোঁয়ায়।
২৫ মার্চ থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কামালের কাছে ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন কমে গিয়ে যুদ্ধের আগ্রহ বেড়ে যায়। কামাল রাউজানের মোহাম্মদপুরে আবদুছ ছালাম সাহেবের বাড়িতে অবস্থান কালে তার সাথে রাতের বেলায় চুপে চুপে লো-ভলিওমে রেডিওয়েতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনত। সব অনুষ্ঠান তার ভাল লাগত। তবে সবচাইতে বেশি ভাল লাগত চরমপত্র অনুষ্ঠান। বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানে প্রচারিত ৭ মার্চের ভাষণের নির্বাচিত অংশগুলো ভাল লাগলেও তা এই ট্রান্‌জিট ক্যাম্পে শোনা ভাষণের মতো এমন ঐশী আবেদনে উদ্ভাসিত ছিল না।
এ ভাষণে স্পন্দিত হওয়া দরদি নেতার মর্মবেদনা যেন সঞ্চিত হয়েছে এই গিরি সংকুল তটদেশে আশ্রয় নেয়া প্রতিটি নিপীড়িত-বিতাড়িত-নির্বাসিত প্রাণের আবেগ অশ্রু দিয়ে। এঁদের দুঃখে ব্যথিত, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এ অন্ধকার আকাশের অদৃশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যখন বলে চলেন, “কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সাথে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।” কামাল চেয়ে দেখে, তার মতো আরো অনেক সম্মোহিত শ্রোতা নীরব কান্নার ব্যথায় জলে টলমল চোখে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে।
“… আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।” এই ট্রানজিট ক্যাম্পে সমবেত প্রতিটি যুদ্ধযাত্রীর মনে হয়; তাঁদের বীজ পুরুষের অলৌকিক সত্তা হয়ে ফিরে আসা এ অকুতোভয় কণ্ঠস্বর রণক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবেলায় তাঁদের নির্দেশ দিয়ে চলেছেন।

SUMMARY

1049-1.jpeg