বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বর্ণমালা

বিশ্বজিৎ ঘোষ  

হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনিই বাঙালির শ্রেষ্ঠতম জাতীয়তাবাদী নেতা। বাঙালির সম্মিলিত চেতনায় জাতীয়তাবোধ সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণতান্ত্রিক মূল্যচেতনা, শোষণ-মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা-এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথা। জাতীয়তাবাদের এই মূলমন্ত্রকে তিনি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন বাঙালির চেতনায়। এভাবেই ইতিহাসের অনিবার্য দাবিতে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই অভিন্ন ও একাত্ম। বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবে এসে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। জনগণের স্বার্থের সঙ্গে, দেশের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে তিনি একাত্মা করতে পেরেছিলেন। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, দেশের স্বার্থের কাছে, জনগণের স্বার্থের কাছে তিনি নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। শোষক ও শোষিতের সংগ্রামে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। বিশ্ব ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয়তাবাদী নেতার দৃষ্টান্ত বিরল। তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি জাতীয় পুঁজির আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষা ও বাঙালির সম্মিলিত মুক্তির বাসনাকে একটি বিন্দুতে মেলাতে পেরেছেন। এ কারণেই তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, এ কারণেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ কারণেই তিনি আমাদের জাতির পিতা।

কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিই নয়, বাংলাদেশের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বস্তুত তাঁর সাধনার মধ্য দিয়েই ভাষা-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন ভাষা-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয় ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের নিম্নোক্ত অংশ।

যাঁরা সাহিত্য সাধনা করছেন, শিল্পের চর্চা করছেন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেবা করছেন, তাঁদের দেশের জনগণের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। দেশের জনগণের চিন্তা-ভাবনা, আনন্দ-বেদনা ও সামগ্রিক তথ্যে তাঁদের জীবনপ্রবাহ আমাদের সাহিত্যে ও শিল্পে অবশ্যই ফুটিয়ে তুলতে হবে। সাহিত্য-শিল্পে ফুটিয়ে তুলতে হবে এ দেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা। সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাঁদের কল্যাণে।...জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।

বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন, তেমনি যুদ্ধোত্তরকালে জাতীয় পুনর্গঠনে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনিই ছিলেন প্রধান চালিকাশক্তি। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনিই প্রধানতম শক্তি ও অনুষঙ্গ। রাজনীতির মতো সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ কথা সমান প্রযোজ্য। জীবিতকালে যেমন, তেমনি মৃত্যুর পরে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সাধনা নিয়ে, তাঁর মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয়ী ভূমিকা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক রচনা। এসব রচনার মধ্যে আছে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, ছড়া-আছে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। এ কথা আজ গভীরভাবে সত্য, বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সৃষ্টিশীলতার এক অফুরান উৎস বঙ্গবন্ধু। কেবল বাঙালি সাহিত্যিকই নন, অন্য ভাষার লেখকরাও তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন, লিখেছেন সৃষ্টিশীল অনেক রচনা। বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত সাহিত্যের পরিমাণ বিপুল, একটি প্রবন্ধে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জরিপ অসম্ভব কাজ। বর্তমান আলোচনায় একটা সংক্ষিপ্ত খসড়া উপস্থাপিত হয়েছে মাত্র।

বাংলা কবিতায় কিংবা বলি গোটা বাংলা সাহিত্যে শেখ মুজিবকে শিল্প-উপাদান হিসেবে প্রথম গ্রহণ করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপনের পরে সমগ্র দেশে যে আলোড়ন ওঠে, তাতে উদ্বেলিত হয়ে সেদিনের তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণ লেখেন 'প্রচ্ছদের জন্য' শীর্ষক কবিতা। উত্তরকালে জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদসহ বাংলাদেশের কবিরা নানা দৃষ্টিকোণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। জসীমউদ্দীন ১৯৭১ সালের অগ্নিগর্ভ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন এই প্রত্যয়দীপ্ত শব্দগুচ্ছে :

মুজিবুর রহমান

ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বান।

বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে

জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞ্ঝা অশনি যেয়ে।

... ...

বাঙলা দেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রসূর্ত রাজ,

প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত তাজ।

(জসীমউদ্দীন/'বঙ্গবন্ধু')

১৯৭৭ সালে, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও ছিল যখন ভয়ংকর এক অপরাধ, সে সময়ে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সবাইকে চমকে দিয়ে নির্মলেন্দু গুণ আবৃত্তি করেন 'আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি' শীর্ষক এক ঐতিহাসিক কবিতা। ওই কবিতায় তিনি বলেন : 'সমবেত সকলের মতো আজিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই দিন গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল/আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।/আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।/শহীদ মিনার থেকে খসেপড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।/আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।'

১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে ৩২ নম্বর বাড়ির যে সিঁড়িতে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ, সেই সিঁড়ি নিয়ে এক অসামান্য কবিতা লিখেছেন কবি রফিক আজাদ। সেই সিঁড়ির রক্তধারাতেই যেন পবিত্র হয়েছে সমগ্র স্বদেশ, পবিত্র হয়েছে স্বদেশের মানচিত্র। রফিক আজাদের ভাষায় : এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙ্গে রক্ত নেমে গেছে-/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।.../স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে পড়ে আছে বিশাল শরীর।

কবিতার মতো উপন্যাস ও ছোটগল্পও লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশাল কর্মকাণ্ড নিয়ে। আনিসুল হকের 'যাঁরা ভোর এনেছিল', সেলিনা হোসেনের 'আগস্টের এক রাত'-এসব উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ করতে হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আবুল ফজল লিখেছেন 'মৃতের আত্মহত্যা' শীর্ষক অসামান্য এক ছোটগল্প। উত্তরকালে সৈয়দ শামসুল হক, রশীদ হায়দার, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আনোয়ারা সৈয়দ হক, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, জাকির তালুকদারসহ অনেক ছোটগাল্পিক বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বিশেষ বিশেষ অনুষঙ্গ নিয়ে ছোটগল্প রচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক নাটক। এর মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী 'পলাশি থেকে ধানমন্ডি' মঞ্চনাটকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এই নাটকের একটি সংলাপ এখানে উল্লেখ করা জরুরি : তাজউদ্দীন : এবারের যুদ্ধ অনেক বেশি কঠিন লিডার।/একাত্তরের যুদ্ধ ছিল একটা বিদেশি হানাদার/বাহিনীর বিরুদ্ধে। এবারের যুদ্ধ একসঙ্গে অনেক/শত্রুর বিরুদ্ধে। এই শত্রুরা আপনার/প্রশাসনের মধ্যেও ঘাঁটি গেড়েছে। /বঙ্গবন্ধু : আমি কি তা বুঝি না? সরকারি আমলা, /পুলিশ-এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও /এরা ঢুকে গেছে। তা না হলে দেশময় /সন্ত্রাস চলছে, পুলিশ তাদের ধরতে/পারে না? দুর্ভিক্ষে মৃতপ্রায় মানুষের /জন্য বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে খাদ্য, /বস্ত্র, ওষুধ আনি, সেগুলো গরিব /দুঃখীকে না দিয়ে নদীর পানিতে/ভাসিয়ে দেওয়া হয়?

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাহিত্য রচনা অব্যাহত এক ধারা। এখন যেমন হচ্ছে, ভবিষ্যতেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হবে। তাঁকে নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্ম পাঠ করলে এই মহান মুক্তিসংগ্রামীকে যেমন জানা যাবে, তেমনি জানা যাবে বাঙালি জাতিসত্তার প্রকৃত ঠিকানা।


মন্তব্য

SUMMARY

1045-1.jpg