রওশন আখতার ছবি
সুলতানা কামালকে সাজিয়ে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। পাশে শেখ রাসেল। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু আর হলো না দেখা, হলো না জমানো কথা শোনা, কেড়ে নিল রাক্ষসেরা আমার প্রাণের বন্ধুকে। বন্ধু, এখনো তোকে মনে পড়ে। এখনো তোকে লালন করি প্রাণের গভীরে, আমৃত্যু তোকে ভাবতে থাকব আর কষ্ট পাব
সুলতানা আহমেদ খুকী, পরে সুলতানা কামাল, সে ছিল আমার বন্ধু। খেলার মাঠে সে ছিল আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। বন্ধুত্ব আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পরাজিত করেছিল।
তখন খুব সম্ভব পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আন্তস্কুল খেলা, আউটার স্টেডিয়ামে। বিভিন্ন স্কুল থেকে প্রচুর খেলোয়াড়ের সমাগম। এর আগেরবার আন্তস্কুলে খেলিনি আমি। কারণ, তখন আব্বার বদলির কারণে স্কুলে নতুন ছিলাম। যাক, সে সময়ই সুলতানা আহমেদ খুকীকে প্রথম দেখি, বেশ চটপটে, ছটফটে, হাসিখুশি; প্রথম দেখায়ই আমার খুব ভালো লাগল তাকে। এর একটা বড় কারণ হতে পারে—গোমড়ামুখো কাউকে আমার পছন্দ ছিল না। তো, ও যখন মাঠে এল, আমার ক্রীড়াশিক্ষক আমাকে বললেন ওকে দেখে রাখো, গতবারের চ্যাম্পিয়ন। আগেই বলেছি, প্রথম দেখাতেই ওকে ভালো লেগেছিল, তবে তখনো আলাপ হয়নি।
রওশন আখতার ছবি
অতঃপর ১০০ মিটার দৌড়ের রেজাল্ট হলো—আমি প্রথম আর খুকী দ্বিতীয়। তাতে কী, ওর মধ্যে সে রকম কোনো মনঃকষ্ট দেখলাম না। আমাকে এসে ও বলল, ‘তুই তো দারুণ দৌড়াতে পারিস।’ না, কথার মধ্যে কোনো রকম রাগ নেই, দুঃখ নেই—একদম খোলামনের একটা মেয়ে। ও এসেছিল মুসলিম গার্লস স্কুল থেকে, আর আমি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল থেকে। আমরা ভীষণ বন্ধু হয়ে গেলাম। সেই শুরু, ওর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটুট ছিল সেই নির্মল বন্ধুত্ব।
খেলা চলতে লাগল, গাঢ় হতে থাকল বন্ধুত্বও। জাতীয় লেভেলে খেলা শুরু। ও মোহামেডান ক্লাবের আর আমি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলতাম। খুকী ছিল ছটফটে টাইপের মেয়ে, সব দিকে ওর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। একদিন খেলা শেষে আমাকে বলল, ‘একটা মজার জিনিস আজ তোকে খাওয়াব।’ স্টেডিয়ামের গেটের বাইরে এক বিহারি লোক পান বিক্রি করত—মিষ্টি পান। খুকী দুটো পান কিনে একটা নিজে মুখে পুরে নিল, আরেকটা দিল আমাকে। প্রথম প্রথম আমার তো ভয়ই লাগছিল, কেউ না দেখে ফেলে। খুকী বলল, ‘আরে তাড়াতাড়ি মুখে দে, মজা চলে যাবে।’ এত মজার জিনিস আগে আর খাইনি। ও বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, ‘এটা আমার আবিষ্কার বুঝলি। এরপর কখনো তুই খাওয়াবি, কখনো আমি।’
দুষ্টুমিতে খুকী ছিল নাম্বার ওয়ান। সব সময় তার মধ্যে একটা আনন্দ-ফুর্তি কাজ করত। যখন পশ্চিম পাকিস্তানে খেলতে যেতাম আমরা, আমাদের লিডার আপার চোখ ফাঁকি দিয়ে এক খাটে ঘুমাতাম। সারা রাত গল্প করতাম, দুজনে ভাগাভাগি করে জামা নিতাম। খুকীদের বাসা ছিল বকশীবাজার আর আমার শান্তিবাগ। বাসায় অ্যানালগ টেলিফোন থাকলেও যখন-তখন টেলিফোন করার মতো পরিবেশ ছিল না বাড়িতে। আমি আর খুকী প্রায় প্রতি সপ্তাহে একে অপরকে একটা করে চিঠি লিখতাম। চিঠিগুলো ভরা থাকত দুষ্টুমিতে, আর ছিল নিজেদের আঁকা ছবিতে ভরপুর। আদতে আমার বন্ধু খুকী ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল সাদামনের মানুষ।
খুকীদের বাড়ির সব মানুষই ছিল খেলার মাঠের মতো—বিশাল হৃদয়ের। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলো তার ভাই বাবুল। খালাম্মাকে দেখতাম বাবুলের জন্য ভাতের থালা সাজিয়ে নির্বাক বসে রয়েছেন। এর কয়েক বছরের মধ্যে খুকীও নিহত হলো ঘাতকের হাতে। যে পরিবার ছিল খেলার মাঠের মতো, পরে সেই মাঠটা পরিণত হলো কবরস্থানে; আর মানুষগুলো যেন পরিণত হলো জীবন্ত লাশে। হায়, খুকীদের পরিবারের সঙ্গে আমার কত কত স্মৃতি!
একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৭২ সাল। আমার এমএসসি পরীক্ষা এবং খুকী ও কামালের (শেখ কামাল) এমএ পরীক্ষার তাত্ত্বিক অংশ শেষ। ব্যবহারিক ও ভাইভার জন্য অপেক্ষা। হঠাৎ করে নিউমার্কেটে খুকী, কামাল ও আরও তিন বন্ধুর সঙ্গে দেখা। দেখামাত্র হইহই করে জড়িয়ে ধরা—আরে দোস্ত কোথায় থাকিস, খোঁজখবর নেই। দোস্ত, অনেক অনেক কথা জমা হয়ে আছে, পরীক্ষার পর সব হবে।
ভারতের স্বাধীনতা দিবসে গ্রামীণ খেলা ও অ্যাথলেটিকসে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি দল। সুলতানা কামাল (বসা অবস্থায় ডান থেকে তৃতীয়) ও রওশন আখতার ছবি (বসা অবস্থায় ডান থেকে পঞ্চম)—দুজনই ছিলেন এই দলে। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু আর হলো না দেখা, হলো না জমানো কথা শোনা, কেড়ে নিল রাক্ষসেরা আমার প্রাণের বন্ধুকে। বন্ধু, এখনো তোকে মনে পড়ে। এখনো তোকে লালন করি প্রাণের গভীরে, আমৃত্যু তোকে ভাবতে থাকব আর কষ্ট পাব।
১৯৬৫ সালে আমরা খেলতে গেছি লাহোরে। কর্তৃপক্ষ যেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল, সেখানে প্রদেশের সব স্থান থেকে দল এসেছিল এবং তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমরা গিয়েছিলাম ১০ জন—চারজন মেয়ে ও ছয়জন ছেলে। সেবার আমাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হলো। আমাদের রুমের বাথরুমে বদনা নেই, বিছানায় ভালো চাদর-বালিশ ছিল না, ডাইনিংয়ে আমরা সবার আগে গেলেও আমাদের খাবার দেওয়া হতো না। আমরা চার মেয়ে এই আচরণ মেনে নিতে পারিনি। একদিনের ঘটনা: সিটিং করে আমরা পরবর্তী সকালে সবার আগে ডাইনিংয়ে এলেও আমাদের খাবার দেওয়া হলো সবার পরে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ করলাম আমরা। সব কাচের পেয়ালা-বাসন ভেঙে ফেললাম ছুড়ে ছুড়ে, কর্তৃপক্ষকেও যথেষ্ট নাকানিচুবানি খাওয়ালাম। এখন ভাবি, যুদ্ধ তো আমরা সেই ১৯৬৫ সালেই শুরু করেছিলাম। আমরা সেই চারজন মেয়ে—আমি, খুকী, কোয়েল, ডলি ক্যাথারিন ক্রজ।
এখন ভাবি, সেই পাকিস্তানি দোসরদের হাতেই কিনা আমার বন্ধু খুকীকে মরতে হলো? সেসব দিনের কথা ভাবলে কষ্ট বুকে দলা পাকিয়ে ওঠে। খুকীর পর ডলি ক্রজও চলে গেছে। দেশের জন্য সে এবং আমরা যুদ্ধ করেছি। সেসব এখানে নয়, পরে আরেক সময় বলা যাবে।
রওশন আখতার ছবি: সুলতানা কামালের বন্ধু; জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খেলোয়াড়।