তুহিন দাস:
কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে এক শ্রেণীর নবাগত তরুণ কবিদের অস্বীকার জ্ঞাপনের তাচ্ছিল্য ও মন্তব্য মাঝে মাঝে শুনি বা চোখে পড়ে সোশাল মাধ্যমে, এরা বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে শামসুর রাহমানের লড়াই দেখেনি, কিন্তু তা বলে কি তারা ইতিহাস পড়বে না? ইতিহাস থেকেও শিক্ষা নেবে না? কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আর শামসুর রাহমান জীবিতকালে বাংলাদেশের প্রধান কবির খেতাব পান, তাকে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের পাঁচ মহৎ কবির পরে বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিপক্ষে সরব। তার কবিতার দেশপ্রেম দিয়ে বহ্নিশিখার মতো তিনি মানুষকে জাগিয়ে রাখতে চেয়েছেন স্বদেশের পক্ষে, বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে। বঙ্গবন্ধু যেমন রাজনীতিতে প্রবলভাবে বাঙালীকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ধারাবাহিক ঘটনা পরাম্পরার মধ্য থেকে যাচ্ছিলেন, সেখানে কবি শামসুর রাহমানও সে সময়ের পত্রিকার পাতায় কবিতায়, প্রবন্ধে, সাক্ষাতকারে, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়তে, মিছিলে, মিটিংয়ে, গণআন্দোলনে, বক্ততায়, গণজোয়ারে প্রচণ্ড সরব তার কবিতা নিয়ে শাসকের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে, প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে তিনি মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য কবিতা লিখছেন, সেসব কবিতা সেসময়ের মানুষকে অধিকার সচেতন ও রাজনীতিমুখী করে তুলেছিল আরো বেশি।
১৯৪৭ এ পাকিস্তান হবার পরপরই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ইচ্ছাপূরণের রাজনীতির বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেছিল ছাত্রসমাজ। ১৯৪৮ এ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবী তুলতে থাকে ছাত্ররা, এর ফলশ্রুতিতে যখন বলা হল উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, বিদ্যুতবেগে প্রতিবাদ ছড়িয়ে গেল। ১৯৫২ সালে ভাষাশহীদরা আত্মত্যাগের বিনিময়ে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করলেন। পরের বছর প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম প্রকাশিত সংকলনে কবি শামসুর রাহমানের কবিতাও প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা সে কবিতায় ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি সহ তিনি শাসকশোষককে জানিয়ে দেন ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে নির্মিত হবে আগামীর মাতৃভূমি। পেশাগত জীবনের সাংবাদিকতা আর লেখালেখি দুই মিশে গেছে ষাটের দশকে পাকিস্তানী থেকে বাঙালী-বাংলাদেশী হয়ে ওঠার অস্তিত্বের লড়াইয়ে, সে মশাল তিনি বিগত শতাব্দীর পুরোটা সময় জ্বালিয়ে রেখেছিলেন দীপ্ত হাতে।
১৯৫৮ সালে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সংবিধান বিলুপ্ত ঘোষণা করে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন, যদিও তিনি মাত্র তিন সপ্তাহ ক্ষমতায় ছিলেন, এবং তারই সেনাপ্রধান আইয়ুব খান তাকে সরিয়ে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। শামসুর রাহমান এই স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে এ বছরেই সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘সমকাল’ পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক ব্যঙ্গাত্মক কবিতাটি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তখন জীবনানন্দ দাশ সদ্য প্রয়াত। তার প্রথম গ্রন্থে জীবনানন্দীয় কাব্যভাষা দ্বারা আক্রান্ত হলেও তিনি পরবর্তী গ্রন্থগুলোতে দ্রুত প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবী ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ নামে উপস্থাপন করেন, যার মূল বিষয় ছিল দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত পাকিস্তানী ফেডারেশনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন। এ কারণে সম্মেলনের উদ্যোক্তারা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যা দিলে তিনি সম্মেলন বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং তার ছয় দফার স্বপক্ষে জনমানুষের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ভ্রমণ ও বক্তৃতা করেন। এ সময়ে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন, তিনি যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ্য করে কবি শামসুর রাহমান লেখেন কবিতা ‘টেলেমেকাস’। তার অংশবিশেষ এরকম—
‘ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে
দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।
এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার।
বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ূধ
আবার অভিজ্ঞ হাতে?
তুলবে না ধনুকে টঙ্কার?’
গ্রীক ইথাকা নগরী তখন অবরুদ্ধ— টেলেমেকাস ব্যথিত, ক্রদ্ধ তার স্বদেশের বন্দীত্বের জন্য। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানও (বাংলাদেশ) ছিল শাসকের হাতে বন্দী, বারবার অপমানিত। গ্রীকবীর টেলেমেকাসের মতো বাংলাদেশের জনতাও অপেক্ষা করে আছে তাদের নেতা আসবেন কারাগার ভেঙে, মুক্ত করবেন বাংলার জনগণকে নাগপাশ থেকে। এই ছিল তার ‘টেলেমেকাস’ কবিতার বিষয়বস্তু।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে কবি শামসুর রাহমান রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। পরের বছর, পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। তখন কবি ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন স্বভাসুলভ মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, সেখানে তিনি জানতে চান— জানাতে চান—
‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো’ বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’
১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতা শেখ মুজিব সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক আসামীদের মুক্তির দাবিতে বাঙালীদের তুমুল গণআন্দোলনের সময়ে পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে তুখোড় ছাত্রনেতা আসাদ নিহত হয়। ঢাকার গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে কবি শামসুর রাহামন লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি—
‘মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে— শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চুড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র— ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’
পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয়েছিল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের। এ ষাটের দশকের কোন এক সময়ে কবি শামসুর রাহমান লেখেন তার ‘পহেলা মে’ কবিতাটি, যা ছিল শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে রচিত এবং শ্রমিক শ্রেণীর অর্থায়নে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিকে প্রথম মুদ্রিত হয় সে কবিতা। ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় পূর্ব পাকিস্তান, অসুস্থ চিকিৎসাধীন মওলানা ভাসানী ক্লিনিক ছেড়ে ছুটে যান বাংলার দুর্গত মানুষদের পাশে। সেখান থেকে পল্টন ময়দানে (এখনকার ইনার স্টেডিয়ামে) জনসভায় বাংলার দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ-ধ্বংসলীলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের প্রকৃতির ধ্বংসলীলা বিষয়ে নিরপদ্রব অভিব্যক্তি-আচরণ নিয়ে মওলানা ভাসানী যে অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা কবি-সাংবাদিক শামসুর রাহমান প্রত্যক্ষ করে লিখলেন ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি লেখেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতা দু’টি। কবি শামসুর রাহমানকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তাকে পাঠকেরা গ্রহণ করে নেয় বাংলাদেশের কবিদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রধান কণ্ঠস্বর হিসেবে, এবং তিনি আমাদের সবসময়ই সঠিক দিশা দিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর লিখিত তার কবিতা গণমানুষের মাঝে আবেগ ছড়িয়েছে, জনপ্রিয়তা পেয়েছে, রাজপথের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই স্বাধীনতা নিয়ে ভাবনার স্বচ্ছ প্রকাশ—
‘স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
….স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।’
‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতায় তিনি স্বাধীনতার জন্য বাঙালীর আত্মত্যাগকে বারবার স্মরণ করেছেন পরম শ্রদ্ধায়, কবি জানতেন দেশ আজ হোক বা কাল স্বাধীন হবে, বাঙালীদের দাবিয়ে রাখা যাবে না। যেমন—
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড হলো।
রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
…তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উডিয়ে, দা
মামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।’
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে তিনি খুনীদের উদ্দেশ্য করে ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতায় লেখেন—
‘আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিড়ি ভেঙ্গে যেতে আসতে
নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে
অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেইখানে দজ্জালদের।’
তিনি ১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন ও কর্মক্ষেত্রে তার ওপর নিয়ন্ত্রণচেষ্টার প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তী কয়েক বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো লেখেন। ১৯৯১ সালে গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলে আবার লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা।’
অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বাংলার জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তার চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমণ্ডুক মৌলবাদী ও তাদের দোসররা, তাকে হত্যার জন্য তার বাসায় চাপাতি হামলা করেছে ১৯৯৯ সালে। কবি আহত হলেও তার কণ্ঠ থামাননি, এতকিছুর পরও তার বিশ্বাসের জায়গায় ছিলেন অনড়। অথচ তারই সমসাময়িক বাংলাদেশের আরেক কবি আল মাহমুদ তখন লিখছেন ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ, কবি আল মাহমুদ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জেলও খাটেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে তাকে জেল থেকে মুক্ত করে শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরী দেন। ‘মিথ্যেবাদী রাখাল’ কাব্যগ্রন্থে তিনি রগকাটা শিবিরকর্মীদের উতসর্গ করে কবিতা লিখেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাতে নিহত শিবিরকর্মীদের শহীদ আখ্যা দিয়ে কবিতা লেখেন নব্বই দশকে। ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালী কাবিন’ এর মত বাংলাদেশের কবিতার প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি কবিতাগ্রন্থ তিনি পাঠককে উপহার দেবার পরেও কবি আল মাহমুদ বারবার সমালোচিত হয়েছেন পাকিস্তানপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মহলের সঙ্গে আপোষের জন্য।
কবি শামসুর রাহমানকে নাগরিক কবি বলা হয়। তিনি তার কবিতায় নাগরিক অনুষঙ্গের সমাবেশ ঘটিয়েছেন বারবার, তাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার কবিতার দেশপ্রেম দিয়ে তিনি জনমানুষের পাশে থেকেছেন, থেকেছেন স্বদেশের পক্ষে। যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে কলম ধরেছেন বারবার, লিখেছেন—
‘যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড়
করিয়ে নিমিষে ঝা ঝা বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উতসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভতস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।’
বঙ্গবন্ধু যেমন রাজনীতিতে প্রবলভাবে বাঙালীকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে বাঙলীকে ধাবিত করেছেন তার মুক্তির পথের দিকে, সেখানে কবি শামসুর রাহমানও সে সময় পত্রিকার পাতায় পাতায় বা মিছিলে প্রচণ্ড সরব তার কবিতা নিয়ে দেশের পক্ষে, প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে তিনি মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য কবিতা লিখছেন। শত বৈরী পরিবেশেও তার কণ্ঠ রোধ করা যায়নি, বরঞ্চ বলেছেন— ‘উদ্ভট এক উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’
কবির প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, সার্ক সাহিত্য পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি দেয়। কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ মারা যান, তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে, নিজ মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
আজকের দিনে, কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
Tuhin Dasলেখক: কবি ও সাহিত্যিক