“রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো..এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন্শাআল্লাহ” রক্ত দোলানো এ কবিতার অমর কবি, রক্ত দিয়ে বাঙালির ঋণ শোধকারী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদাৎ বার্ষিকী ও পবিত্র রক্তে ভেঁজা ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস আজ। এ দিনের ভয়াবহ স্মৃতির বেদনায় জাতি আজ ভারাক্রান্ত।
চিরঞ্জীব, মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক মুজিব মানে স্বাধীনতা, মুজিব মানে একটি মানচিত্র, মুজিব মানে একটি পতাকা, মুজিব মানেই বাংলাদেশ। ৭৫’র ১৫ আগস্ট ঘাতকরা মুছে দিতে চেয়েছিলো পিতার পবিত্র রক্তের চিহ্ন, লোকচক্ষুর আড়াল করতে চেয়েছিলো হিমালয়সম জাতির জনকের মৃতদেহ। ভয়ার্ত বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিলো চাপা দীর্ঘশ্বাস, সেই শোক আজো জেগে আছে রক্তে রাঙ্গানো ওই লাল সবুজের পতাকায়, সেই শোক এখনো অনির্বাণ এ বাংলায়। নদীর স্রোত সাগরের ঢেউয়ের মতো চির বহমান, কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন।
আজ আবারো সেই অন্তিম শোকার্ত বাণী পাঠের দিন, বেদনাবিধূর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন। কবিতার পঙক্তিতে উঠে আসা সেই ধন্য পুরুষ স্বাধীন বাংলার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’র প্রিয় বাংলা মায়ের কোল আর প্রিয় বাঙালিকে ছেড়ে, না ফেরার দেশে চলে যাবার দিন আজ। বাংলাদেশ আর বিশ্ববাঙালির জন্যে গভীর মর্মস্পর্শী শোকের এ দিনটি।
কলঙ্কমুক্ত বাঙালি জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করবে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ, যিনি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জনক। বাংলা মায়ের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) বাংলাদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনদিন ছিন্ন হবার নয়। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দরিদ্র-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা তিনি নিজেই। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সমস্ত গুণাবলী নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষ।
যার রাজনৈতিক জীবন ছিলো বহুবর্ণিল, তাঁর কণ্ঠে ছিলো জাদু। তিনি সেই কবি, যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাসের কবিতা। তিনিই মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগ থেকেই একটি দেশের নামকরণ করেছিলেন ‘বাংলাদেশ’ নামে। জন্ম দিয়েছেন লাল সবুজের একটি পতাকা আর মানচিত্রসহ ‘জয়বাংলা’ উচ্চারণের রক্তকাঁপানো হৃদয়স্পর্শী একটি শ্লোগান। এতকিছুর পরও তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে কুচক্রী বিশ্বাসঘাতকদের বুলেটের কাছে। ব্রাশ ফায়ারের আঘাতে নিভে গেছে তাঁর জীবন প্রদীপ। বার বার ফাঁসির মঞ্চ থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসা জুলিওকোরি শেখ মুজিবকে সামান্য কটা বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝড়া দেহে পড়ে থাকতে হলো ঐতিহাসিক ধানম-ির ৩২ নম্বরের নিজ বাড়ীর দু’তলায় উঠার সিঁড়িতে।
৪১ বছর আগে কালিমাময় এই দিনে জাতি হারিয়েছে তার গর্বের ধন, ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৭১’র পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য সর্বনাশা চক্রান্তে একদল ঘাতকের পৈশাচিকতার বলি হলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার। রচিত হলো ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। কিন্তু তাতেতো একটি জাতির হৃদয় থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি পিতাকে। তাঁকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর যে মৃত্যু নেই, তিনি চিরঞ্জীব, তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। তিনি একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি, যতোদিন রাষ্ট্র থাকবে, ততোদিন অমর থাকবেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি ফিরে আসেন বাঙালির প্রতিটি উৎসব পার্বণে, আনন্দ আর বেদনায়। বাংলাদেশ-বাঙালি-স্বাধীনতা-আর বঙ্গবন্ধু একই সূতোয় গাঁথা। ভয়াবহ ১৫ আগস্ট দিনটি বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়ের পা-ুলিপির পাশা-পাশি পিতা হারানোর বেদনার দিন। জাতীয় শোক দিবসে বাঙালি জাতি গভীর শোক আর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে বাংলাদেশ নামক ভূখ- ও একটি মানচিত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। যথাযোগ্য মর্যাদায় আজ পালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ৪১তম শাহাদাৎ বার্ষিকীর স্মৃতিময় এ দিনটি।
বাংলাদেশের স্থপতির নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার পেতে বাঙালি জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৬টি বছর। প্রতি পদে পদে খুনীদের দোসর ও পৃষ্ঠপোষকতাকারী ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালে দীর্ঘদিন আটকে থেকেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাযজ্ঞের বিচার। অবশেষে সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে মানবতার শত্রু নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনীর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। দীর্ঘ ৩৬টি বছর পরে হলেও বাঙালি জাতি পিতৃহত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়েছে। আর বিচারের দীর্ঘতম প্রক্রিয়া শেষে রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের অত্যন্ত মর্মস্পর্শী করুণ এক অধ্যায়ের। কিন্তু এখনও বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনী বিদেশে পলাতক। ওই পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর এবং যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গিকার নিয়ে কলঙ্কমুক্ত বাঙালি জাতি আজ শোক দিবস পালন করছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ সারাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ, রাজনৈতিক সংগঠন এবার বিস্তারিত কর্মসূচির মাধ্যমে স্মরণ করবে স্বাধীনতার এ মহান স্থপতিকে। হাজার বছরের নিপীড়িত, নিগৃহীত, বঞ্চিত বাঙালি জাতির জন্য জীবনজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে কৈশোর, যৌবন ও পৌঢ়ত্ব উৎসর্গ করেছিলেন ইতিহাসের মহিমান্বিত মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু মুজিব। তাঁর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে এ ভূখ-ের মানুষ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম লাল সূর্য। আমরা পেয়েছি নিজস্ব জাতি রাষ্ট্র, আর গর্বিত আত্মপরিচয়। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস কারাবন্দী রেখেও পাকিস্তানি জল্লাদরা বঙ্গবন্ধুকে বিন্দু পরিমান স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি। কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাষ্ট্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখি নাই, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।
ব্যক্তিত্ব এবং সাহসীকতায় তিনি হিমালয়সম। আর এভাবেই আমার হিমালয় দর্শন।” বাস্তবেও হিমালয়সম বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো দীর্ঘদিনের কাঙ্খিত স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না। সে জন্যেই বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনের পরিবর্তে থাকতেন তাঁর প্রিয় ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানম-ির অপরিসর নিজ বাড়ীতেই। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের সূতিকাগার এই বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিলো বঙ্গবন্ধুর। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি নিয়ে ব্রতী হয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। কিন্তু ৭১’র পরাজিত শত্রুরা বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসীম ও গভীর ভালবাসা ও বিশ্বাসকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। রাতের অন্ধকারে হামলা চালায় স্বাধীনতার স্থপতির নিজ বাসভবনে। কাপুরুষোচিত আক্রমণ চালিয়ে পৈশাচিক পন্থায় ঘাতক দল বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালিকে পিছিয়ে দেয় প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রমিছিল থেকে।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে নরপিশাচ ঘাতকের দল শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, হত্যা করেছিলো একটি স্বাধীনতাকে, একটি জাতির সফলতার স্বপ্ন দেখা ভবিষ্যৎকে। নিষ্ঠুর কায়দায় একে একে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর অনুজ যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি পানি সম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ ও শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, আবদুর নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ কয়েক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। শিশু রাসেলের রক্তভেজা লাশ দেখে খুনীদের প্রতি চরম ঘৃণা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলে মানবতাবাদী বিশ্বের মানুষ। রাজনৈতিক হত্যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন কাল পরিসরে। কিন্তু এর প্রতিটি হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে? এখানে ইতিহাস যেন উল্টো পথযাত্রী! এখানে বিচার বিঘ্নিত।
বিশ্বের ইতিহাসে একসঙ্গে সপরিবারে নির্মূল করতে এত নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকা-ের নজির নেই বললেই চলে। তবুও কী আশ্চর্য, এই ভয়ঙ্কর হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত আত্মস্বীকৃত খুনীদের চূড়ান্ত শাস্তি পেতে কেটে যায় ৩৬টি বছর। বিচারের পথে সৃষ্ট দীর্ঘ বাধার প্রাচীর, বিতর্কিত করেছিলো দেশের সুপ্রিমকোর্ট এবং বিচারপতিদেরও। জাতি দেখেছে এই দীর্ঘ সময়ে নিষ্ঠুর এই ঘাতকদের প্রকাশ্য পুরস্কৃত করার ঘৃণ্য চিত্র। অবশেষে কঠিন বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে- বিচারের বাণীর নিভৃত কান্নার অবসান ঘটলো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির রায় কার্যকর হয় পাঁচ আত্মস্বীকৃত খুনীর। কলঙ্কমুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত হয় গোটা দেশ ও জাতি। ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হলেও এসব ঘৃণ্য নরপশুদের প্রতি বাঙালির ঘৃণা-ধিক্কার কমবে না কোনোদিনও।
জাতীয় শোকের এ দিনে প্রতিটি বাঙালিকে অঙ্গিকার করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর শোষণ মুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার। এ মহান নেতার জীবনকে কোনো রং বা বর্ণ মালায় একত্রীকরণ করা যাবে না। কারণ মুজিব তাঁর সৃষ্টির চেয়েও মহান। তিনি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করা বাঙালি জাতির মহান কর্তব্য। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। তাঁর স্মৃতি আমাদের ভবিষ্যত পথের দিশা। আজ লক্ষ-কোটি কৃতজ্ঞ বিশ্ববাঙালির কণ্ঠে উচ্চারিত হোক, “যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান.. ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।