ফকির ইলিয়াস
প্রতিটি জাতি ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন হয় যোগ্য নেতৃত্বের। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি একটি অবিস্মরণীয় নাম। যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতিসত্তার শৌর্যবীর্যের আত্ম গরিমা। কী চেয়েছিলেন তিনি? এই প্রশ্নটি যদি আবারও করি, তবে এটাই খুব স্পষ্ট জবাব পাব, একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আর কোন লক্ষ্যই ছিল না তার। যে কোনভাবেই একটি রাষ্ট্রের জন্ম হোক, একটি জাতি মাথা উঁচু করে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াক-সেটাই ছিল তার প্রত্যয়। সেই জাতির নাম বাঙালি, সেই রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ।
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের কালরাতে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কেন এই নির্মম হত্যাযজ্ঞটি ঘটানো হয়েছিল তা গেল চৌত্রিশ বছরে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জাতির সামনে। একটি কুচক্রী মহল চেয়েছিল বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির মেরুদ-কে ভেঙে দিতে। আর তা করতে স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে হনন করাটাকেই তারা বেছে নিয়েছিল সর্বাগ্রে। তার পরের সঙ্কটকালীন দিনগুলোর কথা সবার জানা।
একটি মহল মনে করেছিল হত্যার মাধ্যমেই শেখ মুজিব এবং তার আদর্শকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে মুছে ফেলা যাবে। কিন্তু ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা গেছে, জীবিত মুজিবের চেয়ে চিরবিদায় গ্রহণকারী শেখ মুজিব ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন বিশ্বলোকে। প্রজন্মের গহিন হৃদয়ে। শুধু রাজনীতিতেই নয়, শিল্পে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতেও শেখ মুজিব হয়ে উঠছেন প্রজন্মের আলোর আইকন।
আজকের এই নিবন্ধে আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত একটি সমৃদ্ধ কবিতা সঙ্কলন নিয়ে সম্যক আলোচনার চেষ্টা করব। 'বাংলাদেশের আকাশ' শিরোনামে এই কাব্য সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়েছে মার্চ, ২০০৭ সালে। সম্পাদনা করেছেন ইংল্যান্ড অভিবাসী কবি কাজল রশীদ। প্রকাশ করেছে প্রবাস প্রকাশনী ইউকে।
একশ'জন কবির কবিতা স্থান পেয়েছে এই সঙ্কলনে। এরা সবাই বাংলাদেশ আর শেখ মুজিবের স্বপ্নের আরাধনায় নিবেদন করেছেন তাদের হৃদয়ের পঙ্ক্তিমালা। এই আগুয়ান প্রজন্মকে সাক্ষী রেখে তারা ঘোষণা করেছেন আগামী দিনের ইতিহাসের প্রত্যয়। কবিতা কি ইতিহাসের স্বপক্ষে কোন সাক্ষী দিতে পারে? এমন একটি ভাবনা আমাকে সবসময় তাড়িত করে। স্থানিক এবং ভাষিক শিল্পকলার বর্ণনায় একটি ঘটনা যেমন অমরতা পায়, সত্যান্বেষী একটি পঙ্ক্তিও তেমনি প্রজন্মের জন্য রচনা করে যায় প্রতিটি ভোরের আলো স্তম্ভ।
... জানি
আমাদের আউশি জমিন ভুল বৃষ্টিতে ভিজিয়াছে
হায় বীজ! ভুল আর ভুল
পাললিক গ্রন্থি ফুঁড়ে আজও বেরিয়ে আসে
পিতার আঙুল ...
[দিয়েছিলে মাতৃভূমি সোনার পূর্ণিমা/দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু]
হাঁ, সেই পিতার শাণিত আঙুল উচ্চকিত হয়েছিল সাতই মার্চে। বলেছিলেন তিনি,- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
না, মুক্তির সংগ্রাম থামেনি। আর থামেনি বলেই মুজিব এখনও অপরিহার্য আমাদের সমাজ জীবনে। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে। প্রাত্যহিক ভাবনার তালিকায়।
দুই.
একশত আটাশ পৃষ্ঠার এই বলিষ্ঠ গ্রন্থটিতে যারা কবিতা লিখেছেন, তাদের প্রত্যেকের কবিতাই প্রণিধানযোগ্য। এক ধরনের যন্ত্রণা আর চিত্তের অসীম প্রত্যয় নিয়ে সব কবিই দেখাতে চেয়েছেন মুজিবের দু'চোখ দিয়ে স্বপ্নের স্বদেশ।
চিল উড়ে, এই বুক যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়ে যায়
পুকুর শুকিয়ে কাঠতৃষ্ণা নিয়ে তবু জেগে থাকি
পাতিহাঁস দল বেঁধে ছায়া খোঁজে কিন্তু তুমি নেই
জরুরি আগুনে পোড়ে চোখের কোটর ভস্মধার
[ঘুম ভাঙে, স্বপ্ন ভেঙে যায়/খালেদ হোসাইন]
আমাদের সত্তায় সমান হয়ে প্রতিদিন ভোরে যে সূর্য উঠে, সেই সূর্যের গল্প শুনিয়েছেন কবি রবীন্দ্র গোপ তার 'একটি সূর্যের গল্প' কবিতায়। তিনি বলেছেন, 'প্রতিবার ঝড়ের তান্ডবে তোমাকে স্মরণ করি, হে সূর্য, হে স্বাধীনতা, হে মুজিব, হে পিতা।'
যে দেশে এখনও চৌদ্দ কোটি মানুষ মনেপ্রাণে লালন করে একাত্তরের সেই অগি্নজয়ী চেতনা, সে দেশের মানুষ পরাজিত হতে পারে না। তারা জাগবেই। তারা গড়বেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।
দারুণ মিছিল আসে মানুষের মুক্তির মিছিল
আসে চাষা আসে চাষী অস্ত্র তুলে নেয়
আসে ছাত্র আসে যুবা অগি্ন জ্বেলে দ্যায়
আসে মাতা আসে মাল্লা মুক্তির নৌকায়
শ্রমিক মজুর আসে আসে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আসে
ঘরে ঘরে জেগে ওঠে একেকটি শেখ মুজিবুর
[মানুষ জাগবে ফের/আনিসুল হক]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে বিশালতা, তার সঙ্গে কিসের তুলনা করা চলে? আকাশের সঙ্গে? সমুদ্রের সঙ্গে? এমন অনেক প্রশ্ন করা যায়। এই সঙ্কলনটির ভূমিকা লিখেছেন দেশের কৃতী বুদ্ধিজীবী ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তার ভূমিকায় তিনি বলেছেন, 'এই হৃদয়বান পুরুষটি যে নিজেও দেশের হৃদয় জয় করেছেন, যেন এর চেয়ে সহজ সত্য আর হয় না। আমি এই কবিতাগুচ্ছকে বরণ করছি, আর কোন কারণে নয়। বঙ্গবন্ধু মুজিব যে এখনও, স্বদেশে ও প্রবাসে, সব বাঙালির প্রাণের সম্রাট- এই সত্যাটির এক প্রবল ও আন্তরিক উচ্চারণ, এই বিবেচনায়।'
এই সঙ্কলনের প্রতিটি পঙ্ক্তিতে বঙ্গবন্ধু প্রশস্তিই শুধু নয়, বলা হয়েছে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের কথা।
মনে পড়ে সে বিষণ্ন রাতের কথা
কাপুরুষ পশুদের সীমাহীন নির্লজ্জতা
হলুদ পাখিটির ঠোঁটে এক টুকরো খড়
ঠোঁট থেকে খসে পড়ে খড়, মাটিতে মাথা ঠুকে লজ্জায়, গ্লানিতে
[পিতৃঋণ/আবু মকসুদ]
এই সঙ্কলনের অনেকগুলো কবিতায় কবিরা সোচ্চার হয়েছেন মুজিব হত্যার বিচারকার্য সম্পন্ন করার জোর দাবিতে। একটি সুসভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এমন নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিচারকার্য আজও সম্পন্ন হয়নি, তা ভাবতেও গা শিউরে উঠে। খুনিরা এখনও যে দাম্ভিক উচ্চারণ করে যাচ্ছে কিংবা ঘটাচ্ছে একুশে আগস্টের মতো আরও নির্মম পরিকল্পনা। এসব বর্বরতা শুধু বেদনাদায়কই নয়, একটি জাতিসত্তার জন্য হুমকিস্বরূপও। এই সঙ্কলনের কিছু পঙ্ক্তিমালা এখানে উল্লেখ করার জরুরি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে।
ক.
একজন রাখালের বল্লমের খোঁচায় পিতা হারালেন প্রাণ।
যেদিন শস্যের পাহাড় মাথায় করে পিতা ফিরলেন গৃহে
সেদিন হতেই ষড়যন্ত্রের শুরু বাকিটুকু সবাই জানেন
অনেক কাল পেরুল
রোদে মরা তৃণের মতো
শুকিয়ে গেল সময়
আমার পিতার হন্তারকের তবু শাস্তি হলো না।
[পিতা/আশরাফ রোকন]
খ.
এমন দুর্ভাগ্য জাতি এই গ্রহে কখনো আসেনি!
আমাদের ক্ষমা করবেন পিতা,
সম্মুখের দিকে নয়, আমাদের যাত্রা এখন কেবলই পশ্চাতে।
[আমাদের ক্ষমা করবেন পিতা/ইকবাল হাসান]
গ.
পায়ের চিহ্ন ভুলে ঘাসের ডগা জেগে উঠে ফের
আমিও জেগেছি দেখো তোমার মৃত্যুর ভেতর
সমস্ত সঞ্চয় জমা রেখেছি রোদের উমে
শিশির হরণ করে পৌঁছে যাবো আলোর আড়তে
[আমি জন্মেছি তোমার মৃত্যুর ভেতর/আতাউর রহমান মিলাদ]
ঘ.
শুনেছ যুদ্ধের ডাক? সময় যে যায়
খুনিকে করুণা দিয়ে যারা আজ বিজয়ের মৃদঙ্গ বাজায়
'জারজ' এ পরিচয় ইতিহাস আজ শুধু
তাদের জন্যেই কোনো নিঃশব্দে সাজায়।
[পিতৃ পরিচয়হীন/নাসির আহমেদ]
এই সঙ্কলনের একটি কবিতায় খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন কবি সাব্বির আজম। তিনি বলেছেন, ''কোন কোন হত্যা কি জাতি হত্যা নয়?''
হ্যাঁ, পঁচাত্তরের নির্মমতম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে মূলত একটি জাতিকেই হত্যার অপচেষ্টা করেছে খুনিরা। অথচ তারা বুঝতে পারেনি এভাবে খুন করে কোন মহাপুরুষকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয় না। সম্ভব হয় না, বিলুপ্ত করে দেয়া কোন স্বপ্নের সরণি।
তিন.
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বয়স এখন প্রায় আটত্রিশ বছর। এই রাষ্ট্রটির সঠিক ইতিহাস নিয়ে আজও নানা ছলচাতুরি চলছে। একজন মেজরকে দাঁড় করাবার অপচেষ্টা করা হচ্ছে একজন মহামানবের কাতারে। একাত্তরে শেখ মুজিবের কি ভূমিকা ছিল আর অন্য কার কি ভূমিকা ছিল সে সাক্ষী আজও দিচ্ছে দেশ-বিদেশের ইতিহাস। বলছেন দেশ-বিদেশের সমাজ-রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন একজন লাইব্রেরিয়ান। তার নাম, মার্কোস প্যান্টানি। তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আড্ডা দেয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। তিনি বলেছেন, একাত্তর সালে যখন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখন মার্কিনি পাঠকরা উদগ্রীব থাকতেন, বাংলাদেশে কি নির্মম গণহত্যা হচ্ছে, শেখ মুজিব কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা ভেবে। একজন মুজিব সে সময়েই গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতিভূতে পরিণত হয়েছিলেন।
এই প্রজন্মের কাছে মুজিব প্রতিদিন উদ্ভাসিত হচ্ছেন, কবিতায়, নিবন্ধে, চিত্রকলায়, গানে, সুরে, সংস্কৃতির মূচ্র্ছনায়। 'বাংলাদেশের আকাশ' সঙ্কলনটি সেই যাত্রার মহাসড়কে আরেকটি ফলক যুক্ত করেছে। ঐতিহাসিক বিবেচনায় যা একটি উজ্জ্বল কর্ম।
কবি হালিম আজাদ, 'তার তর্জনীর গর্জনে' কবিতায় লিখেছেন
'হে মানুষ গর্বিত কালের মানুষ তোমাকে আবারও ডাকছে সেই মহামানব। যার বর্ণিল সংগ্রামে, স্বাধীনতার ঘোষণার ক্ষুধার্ত-অপমানিত জগৎ ফিরে পেয়েছিল ঘরে ফেরার, দুর্বিনীত তরবারি ''
ভোরের আলোকস্তম্ভে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন ডাক দিয়ে যাচ্ছেন মুজিব। বাঙালির প্রাণের নেতা। বাংলাদেশের আপামর মানুষের স্বাপ্নিক।
সঙ্কলনটি দেশে-বিদেশে ইতোমধ্যেই বহুল আলোচিত, প্রশংসিত হয়েছে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিহাব শাহরিয়ার।
মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা, তিন পাউন্ড, পাঁচ ডলার। উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাকে। সম্পাদক তার কথনে বলেছেন 'ব'-তে বঙ্গবন্ধু 'ব'-তে বাঙালি, 'ব'-তে বাংলাদেশ। হাঁ, সেই বাংলাদেশই আমাদের স্বপ্নের আকাশ।