পাভেল রহমান
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে হুংকার তুলেছিলেন। ওই দিন আমি ছিলাম রেসকোর্স ময়দান থেকে সম্ভবত মাইল দেড়েক দূরে আজিমপুর কলোনিতে। একটি ছোট্ট রেডিওকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনতে জড়ো হয়েছি বড়দের সঙ্গে। আমার তখন ১৫ বছর বয়স। এর এক বছর পর আমি পৌঁছে গেছি স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। ১৯৭২ সালে সেই রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে ক্যামেরা হাতে বঙ্গবন্ধুর এতটাই কাছে যে আক্ষরিক অর্থে হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দিতে পারতাম বঙ্গবন্ধুকে। আমার কাছে এ এক অবিশ্বাস্য-অবিস্মরণীয় স্মৃতি।
তারও আগে...
৩ মার্চ ১৯৭১। পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান শেষে আমরা ‘জয় বাংলা বাহিনীর’ (বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য গঠিত বাহিনী) সদস্যরা মার্চপাস্ট করে বঙ্গবন্ধুকে সালাম জানাতে এসেছিলাম ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। বঙ্গবন্ধু বাসার লোহার গেট ধরে সালামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের কমান্ডার হেলালুর রহমান চিশতী ভাই ‘আইজ রাইট’ বলে কমান্ড দিয়েছিলেন। তখন আমি ডানে তাকিয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু! সেই আমার স্বচক্ষে বঙ্গবন্ধুকে দেখা! বঙ্গবন্ধু আর সাতই মার্চের ভাষণ আমাকে এতটাই উজ্জীবিত করে তুলেছিল যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মে মাসের এক সকালে আজিমপুর এতিমখানায় বোমা ছোড়ার পরিকল্পনায় ‘রেকি’ (ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন) করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলাম। তবে আমার কমান্ডার মাসুদ ভাই ও আমার মনোবল ছিল অটুট। তা ছাড়া বয়সটাও তো একটি ব্যাপার ছিল। যদিও সশস্ত্র পাকিস্তানিদের সামনে আমাকে নিয়ে মাসুদ ভাইয়ের শঙ্কা ছিল, ‘ছোট মানুষ’ আমি বুঝি সব ফাঁস করে দেব। কিন্তু না, প্রকাশ করিনি। পাকিস্তানি বাহিনীর রাইফেলের মাথায় লাগানো বেয়নেটের খোঁচা খেয়ে কেবল নিজের বাসার ঠিকানাই বলতে বাধ্য হয়েছিলাম।
ওরা আমাদের ছেড়ে দিল। বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়েছি বলে বোমা ছুড়ব না, তা কি হয়? সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা বোমা ছুড়ব এবং তা আজই! আর বাড়িতে বাবা-মা-ভাইবোনকে ছেড়ে কোথাও পালাব না। কেননা, আমাদের লিখে দেওয়া ঠিকানায় ওরা এসে না পেলে বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলবে। দেশের জন্য এটুকু করার সাহস প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে সেদিন গেঁথে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ।
১৯৭২ সালে রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে আসেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন বাবার শখের মিনোলটা ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছি সম্মেলনের। সেখানে ছিলেন দেশের বরেণ্য আলোকচিত্রী সাংবাদিকেরাও। এমন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমি এসেছি এই প্রথম। আর প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই যেন বাজিমাত। নিউমার্কেটের মোল্লার ছোট্ট টং দোকান থেকে কেনা পাঁচ টাকা দামের এডিসির কাট ফিল্মে তুলে ফেলেছি অন্য এক ছবি, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতার এক ছবি। ছবিটি ছিল—প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শামিয়ানার ভেতর পোস্টার প্রদর্শনী দেখছেন আর সেই মুহূর্তে তাঁরই পায়ের কাছে দুই টোকাই শামিয়ানার নিচ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখছে।
বঙ্গবন্ধুর ওই ছবি প্রকাশের পর আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক জয়ধ্বনি’ থেকে নিয়ে আসে কমিউনিস্ট পার্টির ‘সাপ্তাহিক একতায়’। মাসিক বেতন ১০০ টাকা। ১৭ মার্চ ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার অ্যাসাইনমেন্টে যাই আমি। সকালে খেলাঘরের ছোট্ট মণিদের সঙ্গে বাসভবনে বেশ কিছু ছবি তুলতেই বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের সঙ্গে আমার দেখা এবং পরিচয়। কামাল ভাই প্রথম পরিচয়েই আমাকে আবাহনীর ছবি তোলার দায়িত্ব দিলেন। আর এভাবেই আমি ৩২ নম্বরের ধানমন্ডির ওই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। সন্ধ্যায় গণভবনে শেখ কামাল ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। এ আরেক অবিস্মরণীয় স্মৃতি আমার! আবাহনী ক্রীড়া চক্রের দেশবরেণ্য খেলোয়াড় সালাউদ্দিন নান্নু, সামচু ভাই, সাদেক ভাই, অমলেশদা আবাহনী ক্রীড়া চক্রের অফিশিয়াল হারুন ভাই, তারেক ভাই, ফোকলা ভাই, মন্টু ভাই, বাদল ভাই আর বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের সঙ্গে পেয়ে যাই বঙ্গবন্ধুকেও।
বড় ছেলে শেখ কামালের গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: পাভেল রহমান
ভাবলে আজও বিস্মিত হই এই ভেবে যে দেশের সুপারস্টার সব খেলোয়াড়ের সামনে আমার মতো অখ্যাত পাভেলকে পরিচিত করালেন শেখ কামাল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। কামাল ভাই বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘আব্বা, ও আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার।’ জন্মদিনের সন্ধ্যায় সবুজ লনে আধো আলো আধো ছায়ায়, সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে, আরামকেদারায় গা এলিয়ে বসে ছিলেন দারুণ এক সুপুরুষ বঙ্গবন্ধু। কামাল ভাইয়ের কথায় যেন নড়ে বসলেন! ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। মুচকি হেসে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বলিস কী?’ তোদের আবাহনীতে আবার ফটোগ্রাফারও আছে নাকি?’ বিস্মিত বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন। কামাল ভাই বলে চলেছেন, ‘হ্যাঁ আব্বা, আছে তো, আর ওর নাম হচ্ছে পাভেল।’ বঙ্গবন্ধুর এক হাতে আমার বাঁ হাত, অন্য হাত আমার বাঁ গাল ছুঁয়েছে। বললেন, ‘বাহ, কী চমৎকার নাম তোমার!’
বঙ্গবন্ধুর স্নেহমাখা মধুর আবেশ আমার জীবনকে রাঙিয়ে দিল সেই সন্ধ্যায়!
সেই রাতে আবারও এলাম গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর অফিসে। আর সেখানে পেয়ে গেলাম ইতিহাসের এক খলনায়ককে। তিনি এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। অন্য একদিন গণভবনে সভা চলছে। আমি ছবি তুলছি। সভায় উপস্থিত এম মনসুর আলী, জিল্লুর রহমান, শেখ মণি, শেখ শহীদসহ জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। বঙ্গবন্ধু সভাপতির বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি ছবি তুলছি। আমার সঙ্গে ছবি তুলছেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত আলোকচিত্রী মোহাম্মদ আলম। আকস্মিক আমার ফ্ল্যাশের আলো বঙ্গবন্ধুর চেহারায় পড়তেই তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন, আর আমার দিকে ফিরে তাকালেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি অপ্রস্তুত।
কী হলো, কী হলো?
ছোট ছেলে শেখ জামালের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: পাভেল রহমান
চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। আমি ভীত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেলি। আবার চোখ তুলতেই দেখি, তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে। হৃৎকম্পন বাড়তে থাকে আমার। আমি চোখ নামিয়ে ভাবছি, তিনি কি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন? আবারও চোখ তুলতেই দেখি, তিনি তেমনি তাকিয়ে আমার দিকে। সভায় উপস্থিত অন্যরাও আমাকে দেখতে শুরু করেছেন। যেন পুরো হল দেখছে আমাকেই। আমি ঘামতে থাকি। এবার চোখ তুলে দেখি, বঙ্গবন্ধু মুচকি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে। বললেন, ‘তুমি দেখো, তোমার এই ছবিটা দারুণ হবে।’ এ কথায় আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর নামে।
এমন আশীর্বাদের পর জীবনে আর কীই-বা চাওয়ার থাকতে পারে?