হুলিয়া: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা


১৯৭০ সাল। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্যা প্রকট। মুক্তির আকাংখায় উত্তাল পূর্ব বাংলা। জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভের ফলে ‘বাংলাদেশ’ ভূখণ্ডে নতুন স্বপ্ন’। তরুণরা নতুন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে স্বপ্নের ঘর আর বারান্দা তৈরি করছে। চলছে মিছিল। মিটিং। গোপন বৈঠক। প্রকাশ্য সভা। ওদিকে পাক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের ওপর চালাচ্ছে জুলুম মামলা-হামলা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এক সদ্য যুবক হুলিয়া বুকে নিয়ে ঘরছাড়া। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বাড়ি ফিরছে সে। মফস্বল শহর নেত্রকোনায় তার বাড়ি। ঢাকার রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে তখন সবার চোখ। কী ঘটছে ঢাাকয়? শেখ মুজিবের খবর কী? সাত কোটি বাঙ্গালি তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে। সবার আশা আকাংখার কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।—এরকম প্রেক্ষাপটে রচিত কবি নির্মলেন্দু গুণ রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতা-ই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর প্রথম কবিতা এটি।

হুলিয়া

নির্মলেন্দু গুণ

আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ্দুর—’
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে।

কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহাকুমা স্টেশনে উঠেই
আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
কাঁধে হাত রেখে চিৎকার করে উঠেছিল;—আমি সবাইকে
মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি।
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
বারবার চেয়ে দেখলেন—, কিন্তু চিনতে পারলেন না।
বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনল না।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি।
সে একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি।

আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিক্চিক করছে রোদ,
শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া।
অনেক বদলে গেছে বাড়িটি,
টিনের চাল থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনোখানে।

পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো।
স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চর্তুদিকে ঘাস, জঙ্গল,
গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি।
একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
আমাকে দেখেই পালাল একজন, গন্ধ শুঁকে নিয়ে
আমাকে চিনতে চেষ্টা করল—যেমন পুলিশ-সমেত চেকার
তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল।
হাঁটতে-হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙে-যাওয়া অশোক,
একসময় কী ভীষণ ছায়া দিত এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারত এর ছায়ায়।
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়েছিলুম।
সেই বাসন্তী, আহা সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার-সন্তানের জননী হয়েছে।

পুকুরের জলে শব্দ উঠল মাছের, আবার জিভ দেখাল সাপ,
শান্ত-স্থির বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে…।
আমি বাড়ির পেছন থেকে শব্দ করে দরজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম—‘মা’।
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে-দরোজায় কোনো কণ্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল।
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দি হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম।

মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে
লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে
পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন; আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,
দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,
সেখানে লেনিন, বাবার জমা-খরচের পাশে কার্ল মার্কস;
আলমিরার একটি ভাঙা-কাচের অভাব পূরণ করছে
স্ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি।

মা পুকুর থেকে ফিরছেন, সন্ধ্যায় মহাকুমা শহর থেকে
ফিরবেন বাবা, তাঁর পিঠে সংসারের ব্যাগ ঝুলবে তেমনি।
সেনবাড়ি থেকে খবর পেয়ে বৌদি আসবেন,
পুনর্বার বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন আমাকে।
খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,
তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য।
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস।
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
—আমাদের ভবিষ্যত কী?
—আইয়ুব খান এখন কোথায়?
—শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?
—আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?

আমি কিছুই বলব না।
আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে
বাঙলার বিভিন্ন ভবিষ্যৎকে চেয়ে চেয়ে দেখব।
উৎকণ্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার, আমি চিৎকার করে
কণ্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলব;
‘আমি এ সবের কিছুই জানি না,
আমি এ সবের কিছুই জানি না।’

SUMMARY

1013-1.jpg