এহ্তেশাম হায়দার চৌধুরী ||
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাজীবন ধরে তিনি অপরিসীম ত্যাগ তিতিক্ষা আর জেলজুলুম সহ্য
করে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে একটি স্বাধীন মানচিত্র এনে দিয়েছিলেন। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে এ ভূখ-ের নাম বাংলাদেশ, লাল সবুজ যার পতাকার রঙ। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দু’লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম সে পতাকার অহংকারবঙ্গবন্ধ,ু বাঙালি আর বাংলাদেশ এ তিন সত্তা এক, অভিন্ন। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। জাতির মুক্তির জন্য তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করে বঙ্গবন্ধু হিসেবে সবার হৃদয়ে অভিষিক্ত হয়েছেন। বিশ্বের দরবারে হয়েছিলেন ; নিপীড়িত জনতার অবিসংবাদিত মহান নেতা। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রেরণার উৎস। তাই তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষার কবি সাহিত্যিকরা অসংখ্য সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। বিশেষ করে কবিতায় দেশে বিদেশে কবিরা বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক সংগ্রামী জীবনকে বিভিন্ন উপমা উৎপ্রেক্ষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে,সেসব থেকে কিছু সংখ্যক এখানে তুলে ধরছি। আমাদের দেশে নির্মলেন্দুগুণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতা রচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রহার পিষ্ট বাঙ্গালি জাতির সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, স্বপ্ন সম্ভাবনাকে হৃদয়ে ধারণ করে বাঙ্গালির আপন হয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই। পাকিস্তানিদের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে তিনি ধীরে ধীরে বাঙ্গালিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন । সে প্রস্তুতি পর্বে ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচি যখোন জাতির সামনে উপস্থাপন করেন ,তখোন আবেগাপ্লুত তরুণ কবি ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে ‘প্রচ্ছদের জন্য’ কবিতাটি লেখেন এবং ‘দৈনিক সংবাদে’ তা ছাপাও হয়। পরে অবশ্য কবি এ কবিতার নাম বদলিয়ে ‘স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায়’ নামকরণ করেন। ৬৯’ এর গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গুণ লিখেন ‘হুলিয়া, নামের সে বিখ্যাত কবিতা খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন তিনমাইল বৃষ্টির পথ রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য রাতে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আসবে আব্বাস ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর আমাদের ভবিষ্যৎ কী . আইয়ুব খান এখন কোথায় শেখ মুজিব কি ভুল করছেন? আমার নামে কতদিন আর হুলিয়া ঝুলবে? ;(নির্মলেন্দু গুণ/ হুলিয়া)
বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের ত্যাগ তিতিক্ষা আর বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আপোষহীনতার
চেতনাদৃপ্ত রূপ স্বাধীনতার আগেই তুলে ধরেছেন সিকান্দার আবু জাফর তার
‘ইতিহাসচারিনী বাঙলা’ কবিতায়। ভেঙ্গে যাবে শত্রুর যত ষড়যন্ত্র জনগণের বাংলা পাবে গণতন্ত্র দুর্বার মুজিবের দুর্জয়মন্ত্র জয় জয় জননী বাংলা সিকান্দার আবু জাফর/ ‘ইতিহাস চারিনী বাঙলা’) ৭১’এর অসহযোগ আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে এক গুরত্বপূর্ণ অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর
সংগ্রামী চেতনা,বাংলার মানুষের জন্য গভীর মমত্ববোধ,বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের
জন্য গভীর দরদ- পল্লী কবি জসীমউদ্দীনকে মুগ্ধ করে। তিনি ১৯৭১ সালের
১৬মার্চ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখেন এক আবেগঘন দীর্ঘ কবিতা বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূতৃ রাজ প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার রক্ততাজ। .........................................
শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী জীবন করিয়া দান মিলাতে পারেনি প্রেম বন্ধনে হিন্দু মসরমান। তারা যা পারেনি তুমি তা করেছো ধর্মে ধর্মে আর জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাংলার। জসীমউদদীন/বঙ্গবন্ধু) তিরিশ
লক্ষ শহীদ আর দু‘লক্ষ মাবোনের সমভ্রমের বিনিময়ে আর্জিত হয় আমাদের
স্বাধীনতা। কিন্তু এ স্বাধীনতা যেন অর্থহীন মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া।
বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে রেখে বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হতে পারে না
বাঙ্গালি জাতি। সবাই তাঁর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়। সমগ্র জাতির এ
প্রত্যাশা ফুটে ওঠেছে সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায় মুক্তিকামী মানুষের শুভেচ্ছার পথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসছেন বাংলাদেশে নির্ভয় ভবিষ্যতের স্বপ্নদীপ্ত নিরঙ্কুশ প্রত্যাশার পথে। (সিকান্দার আবু জাফর/ ফিরে আসছেন শেখ মুজিব) ১৯৭২
সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবসে তখোনকার কবি কামাল
চৌধুরী, কাজী রোজী, জাহিদুল হক আবেগ উদ্বেলিত অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন
তাদের কবিতায় তিনি ফিরে আসলেন ধংসস্তু‘পের ভিতর ফুটে উঠল কৃষ্ণচূড়া মুকুলিত হ’ল অপেক্ষার শিমুল শোক থেকে জেগে উঠলো স্বপ্ন; রক্তে বাজল দামামা বেদনার অশ্রুরেখা মুছে ফেলে ‘জয়বাংলা জয়বাংলা’ বলে হেসে উঠল<br>লতাগুল্ম, ধুলিকণা,পরিপূর্ণ দীপ্ত পতাকা। (১০ জানুয়ারি/ কামাল চৌধুরী) ৭৫’এ
ঘাতকের নির্মম বুলেট বঙ্গবন্ধুর প্রাণ কেড়ে নিলে গোটাজাতি শোকাহত হয়। সে
শোক ছুঁয়ে যায় আমাদের কবিহৃদয়েও। নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান, আল
মামুদ,মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, আবদুল্লা আবু সাঈদ, শহীদ
কাদরী আসাদ চৌধুরী প্রমুখ কবিরা তাদের মর্মবেদনার স্বরূপ তুলে ধরেন তাদের
কবিতায় যে ঘাতক তোমার সুবিশাল ছায়াতলে থেকে কেড়ে নিলো তোমার নিঃশ্বাস শিশুঘাতী, নারীঘাতী; ঘাতকেরে যে করিবে ক্ষমা তার ক্ষমা নাই, আমরণ অনুগত তোমার অবাধ্য হবো আজ পিতা, অনুমতি দাও আজ। (আসাদ চৌধুরী/ পিতা, অনুমতি দাও) বাংলাদেশের
মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধু সমহিমায় উজ্জ্বল। যে পাকিস্তÍানিদের
বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করেছি, তাদের বর্বরতা আর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়িয়েছি- সে পাকিস্তানের কবিরাও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা
করেছেন। বিখ্যাত ঊর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, আহমদ সালিম, সৈয়দ আশিক শাহকার
প্রমুখ কবিদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু জীবন চরিত্র ফুটে ওঠেছে- এই স্বাধীনতা অনেক মূল্য দিয়ে পাওয়া এই মূল্য জীবন দিয়ে শোধ করেছে তোমার সন্তানেরা তারাই ছিনিয়ে এনেছে তোমার জন্য এ গৌরব (সৈয়দ আশিক শাহকারের কবিতা) পাকিস্তানের
সিন্ধি কবি আরজ বালুচ,কবি আজমল খটক, পাঞ্জাবি কবি হাবিব জাহেলসহ
পাকিস্তানের অসংখ্য কবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। ১৯৭১ সালে
পাকিস্তানি কবি আহমদ সালিম বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কবিতা রচনা করে
জেলও খেটেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান
অস্বীকার্য। ভারতের অনেক কবিও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। তাদের
মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদাশংকর রায়, কাইফি আজমি, নন্দেশ্বর সিংহ, এ কে
শেরাম উল্লেখযোগ্য। অন্নদাশংকর রায়ের সে বিখ্যাত দুটি চরণ প্রায় প্রবাদ
প্রবচনের মতো বাঙালির মুখে মুখে-যতদিন রবে মেঘনা যমুনা গৌরী প্রবাহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানএছাড়াও ৭৫’ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে ভারতীয় কবি নীলকান্ত তাঁর ‘শেখ মুজিবের মহাপ্রয়াণে’ কবিতায় লেখেন-হে বঙ্গবন্ধু নিষ্ঠুুর বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছো শুনে পেরিয়েছিলাম এক অস্থির সময় খোলা জানালা দিয়ে সুদুর আকাশের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থেকেছি উত্তরহীন এক প্রশ্ন নিয়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে গড়েছিলে স্বদেশ তোমার কিন্তু এ কোন প্রতিদান পেলে তুমি। (কবি নীলকান্ত; ‘শেখ মুজিবের মহাপ্রয়াণে’) এ
ছাড়া জাপানি কবি মাৎসুঅ শুকুইয়া, জার্মানি কবি ইয়াপ লুইপকে, বসনিয়ার কবি
ইভিংসা পিসেস্কি এবং বৃটিশ কবি টেড হিউজ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের নিজস্ব
ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন।বঙ্গবন্ধু দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে এক
লৌহমানব। তাঁর চিন্তা চেতনা তাঁরস্বপ্ন, তাঁর অপরিসীম আত্মত্যাগের
ফলশ্রুতিতে মরণভীতু বাঙালিজাতি জাগরণের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার
যুপকাষ্টে প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কাছে এ জাতির; ঋণ
অপরিশোধ্য। তাঁকে নিয়ে দেশে বিদেশে বিভিন্ন ভাষায় আরো কবিতা লেখা হবে, আরো
গবেষণা হবে।
লেখক পরিচিতি ঃ
গল্পকার ও উপন্যাসিক।
তথ্যসূত্র * বাংলাদেশের সাহিত্য/ বিশ্বজিৎ ঘোষ*
বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা/সাইফুল্লা মাহমুদ দুলাল সম্পাদিত